Bulldozer

সীমা না ছাড়িয়ে

নাগরিক অপরাধী, অভিযুক্ত বা অপ্রিয় বলে তার বাড়ি বুলডোজ়ারে গুঁড়িয়ে দিলে প্রশাসনের প্রবলপ্রতাপী ও দণ্ডদাতা রূপটি নাগরিকের সামনে ফুটে ওঠে, বস্তুত সেটিই ওই রাজ্য সরকারগুলির উদ্দেশ্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৪ ০৪:৪৭

ভারতের সংবিধান নাগরিকের বাসস্থানের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে মৌলিক অধিকার হিসাবে। সেই অধিকারের বৃহত্তর ও প্রসারিত অর্থটি বাসস্থানের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথাও বলে, যে কাজটি করার কথা প্রশাসনের। অথচ সাম্প্রতিক ভারতে এর পুরো উল্টো ছবিটাই দস্তুর হয়ে উঠেছিল। মধ্যপ্রদেশ উত্তরপ্রদেশ উত্তরাখণ্ড-সহ বিজেপি-শাসিত নানা রাজ্যে দেখা যাচ্ছিল, কোনও অভিযুক্ত বা অপরাধীর বাড়ি বুলডোজ়ারে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সরকারই: পুলিশ বা পুর-প্রশাসনের মাধ্যমে। বিরোধী দল ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিবাদস্বরূপ সুপ্রিম কোর্টে মামলাও হয় এর বিরুদ্ধে, তারই রায়ে সম্প্রতি শীর্ষ আদালত স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, কেউ অপরাধী বলেই প্রশাসন তার বাড়ি বুলডোজ়ারে গুঁড়িয়ে দিয়ে দণ্ডদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে না। গণতন্ত্রে এ কাজ বেআইনি, স্বেচ্ছাচারের শামিল— তার দায় নিতে হবে সরকারকেই, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সরকারি আধিকারিকদের বেতন কেটে বাড়ি ধ্বংসের ক্ষতিপূরণও দিতে হবে।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্টের এই রায় প্রশাসনের এক্তিয়ার আরও এক বার স্পষ্ট করে দিল। নাগরিক অপরাধী, অভিযুক্ত বা অপ্রিয় বলে তার বাড়ি বুলডোজ়ারে গুঁড়িয়ে দিলে প্রশাসনের প্রবলপ্রতাপী ও দণ্ডদাতা রূপটি নাগরিকের সামনে ফুটে ওঠে, বস্তুত সেটিই ওই রাজ্য সরকারগুলির উদ্দেশ্য। অথচ এ কাজ সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক, কারণ প্রশাসনের কাজ ‘আইনের শাসন’ নিশ্চিত করা, কোনও অবস্থাতেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া নয়। দণ্ডদানের ন্যূনতম অধিকার তার নেই, আইনের ঊর্ধ্বে উঠে সে কাউকে দোষী বলে দাগিয়ে দিতে পারে না। সুপ্রিম কোর্ট কড়া ভাষায় বলেছে, কেউ অপরাধী কি না, কোন নির্মাণটি বৈধ বা অবৈধ, তা নিরূপণের সিদ্ধান্ত আদালতের— সরকার, পুলিশ বা পুর-প্রশাসনের আধিকারিকরা বিচারক নন। তাই অতীতে শিবরাজ সিংহ চৌহানের আমলে মধ্যপ্রদেশ সরকার, বা এই সময়ে উত্তরাখণ্ডে পুষ্কর সিংহ ধামী বা উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সরকার যে ভাবে নিজেরাই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলছে এবং বুলডোজ়ারে বাড়ি গুঁড়িয়ে তার ‘বিচার’ও করে ফেলছে তা অবৈধ, অসাংবিধানিক, ভারতীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ যে মানবাধিকার ও মানবিকতা-বিরোধী তা বলে দিতে হবে না, রাতারাতি মহিলা বৃদ্ধ ও শিশুদের এ ভাবে বাড়িছাড়া করা যায় না।

এমন নয় যে এই কথাগুলি আগে বলা হয়নি। আইনের শাসনের অর্থ, প্রশাসনের লক্ষ্মণরেখার প্রসঙ্গ এর আগে বারংবার উঠে এসেছে আদালতের নানা পর্যবেক্ষণে। তার পরেও জারি থেকেছে বুলডোজ়ারের আগ্রাসন, প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছে— বাড়ি দোকান ইত্যাদি নির্মাণগুলি অবৈধ বলেই তাদের ভেঙে ফেলা হচ্ছে। শীর্ষ আদালতের সাম্প্রতিক রায়ে সেই কুযুক্তিও গুঁড়িয়ে যাওয়ার কথা; এ বার থেকে কোনও বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে গেলেও তা করতে হবে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে— সংবিধানের ১৪২ ধারা অনুযায়ী বিশদ নির্দেশিকা জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট। বিচারব্যবস্থা আরও এক বার সংবিধান ও নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষায় দিগ্‌দর্শকের ভূমিকা পালন করল, ভারতের গণতন্ত্রের পরম সৌভাগ্য। আর দুর্ভাগ্য, এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হল গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ প্রশাসনকেই।

আরও পড়ুন
Advertisement