TMC

একাধিপত্য

শীর্ষ নেতৃত্ব চাহিলে এই প্রবণতা বন্ধ করা যাইত না, তাহা বিশ্বাস করা কঠিন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২২ ০৮:৩৪
ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

১০৮টির মধ্যে ৩৬টি পুরসভা বিরোধীশূন্য। কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে বাকিগুলিতেও বিরোধীরা টিমটিম করিয়া জ্বলিতেছেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ইহাকে নির্ভেজাল জনাদেশ বলিলে অনৃতভাষণ হইবে। সত্য যে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিপুল ভাবে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে ভোট দিয়াছেন। কিন্তু, সেই ভোটেও এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা দুষ্কর, হয়তো অসম্ভবই। ভোটের দিনের বিভিন্ন ছবি, বহু মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা সৌগত রায়ের ন্যায় প্রবীণ সাংসদের খেদোক্তিকে মিলাইলে তৃণমূল কংগ্রেসের এই অবিশ্বাস্য ‘সাফল্য’-এর কারণটি বোঝা যাইবে— নির্বাচনে কারচুপি হইয়াছে। বিরোধীদের মতে প্রবল কারচুপি; অন্যদের মতে, খানিক। এইখানেই একটি ধাঁধার সৃষ্টি হয়। গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট হইয়া গিয়াছিল যে, রাজ্যের মানুষ এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের উপর আস্থা পোষণ করেন। এবং, অতীত অভিজ্ঞতা হইতে ইহাও স্পষ্ট যে, রাজ্যে যে দল ক্ষমতাসীন অথবা ক্ষমতার প্রায়-নিশ্চিত দাবিদার, পুরভোট বা পঞ্চায়েত ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সচরাচর সেই দলকেই ভোট দিয়া থাকেন। ফলে, একেবারে অবাধ নির্বাচন হইলেও তৃণমূল কংগ্রেসই অধিকাংশ পুরসভায় জিতিত— এমন অস্বাভাবিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকিলেও খুব কম হইত না— এই কথাটি প্রায় নিশ্চিত করিয়াই বলা চলে। তাহার পরও নির্বাচনে কারচুপি, বা গাজোয়ারির প্রয়োজন পড়িল কেন? বিশেষত, গত দফার পঞ্চায়েত ও পুরভোটে গাজোয়ারির প্রতিক্রিয়া শাসক দলের অনুকূলে যায় নাই— ২০২০-২১’এ যে প্রবল বিজেপি হাওয়া উঠিয়াছিল, তাহার একটি কারণ ছিল শাসক দলের নির্বাচনে গাজোয়ারির অভিযোগ। তাহার পরও, এই অনুকূল অবস্থাতেও, এই অস্বাভাবিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের প্রয়োজন পড়িল কেন? শীর্ষ নেতৃত্বই বা তাহা করিতে দিল কেন?

এই ধাঁধার উত্তর অন্তত দ্বিমাত্রিক। প্রথমত, কেহ অভিযোগ করিতেই পারেন যে, গণতন্ত্রের অনুশীলনে এমনই অনভ্যাস জন্মিয়াছে যে, সেই পথে হাঁটিবার কথা কাহারও মনেও পড়ে না। রোগটি শুধু পশ্চিমবঙ্গের নহে, শুধু বর্তমান জমানারও নহে— কিন্তু, যেখানে যাহার জোর, সে দল সেই মুলুকের অখণ্ড দখল লইবে, এই প্রবণতাটি অতি বাস্তব, এবং অতি বিপজ্জনক। আজ যাঁহারা রাজনীতির রথী-মহারথী, অথবা নিতান্ত পদাতিক, তাঁহাদের অধিকাংশেরই গণতন্ত্রের প্রকৃত অনুশীলনের অংশীদার হইবার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নাই। তাঁহারা এই দখলদারির গণতন্ত্রেই অভ্যস্ত। ফলে, মানুষের রায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হইবে, এই কথাটি তাঁহাদের নিকট অতি অস্বাভাবিক ঠেকিয়াছে। তাঁহারা জানেন, মানুষ ভোট দেয় না, ভোট করাইতে হয়।

Advertisement

কিন্তু, শুধু অভ্যাসের স্কন্ধে দায় চাপাইলে খণ্ডদর্শন হইবে। শীর্ষ নেতৃত্ব চাহিলে এই প্রবণতা বন্ধ করা যাইত না, তাহা বিশ্বাস করা কঠিন। দুর্জনে বলিবে, সম্ভবত শীর্ষ নেতৃত্বের তাহা চাহিবার উপায় নাই। এই রাজ্যে রাজনীতিই যে বৃহত্তম কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র, তাহা এখন প্রশ্নাতীত। যত ক্ষণ ক্ষমতা আছে, তত ক্ষণই কর্মসংস্থান। দুই পয়সা আয় না হইলেও কর্মীরা দলের প্রতি জান লড়াইয়া দিবেন, নেতৃত্বের হয়তো সেই ভরসা নাই। ফলে, দল ধরিয়া রাখিতে হইলে উপার্জনের ব্যবস্থাও রাখিতে হইবে। পুরসভায় জিতিলেই হয় না— প্রতিটি ওয়ার্ডেই উপার্জনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, নচেৎ সেই ওয়ার্ডে দলীয় কর্মীরা হীনবল হইয়া পড়িবেন। সম্ভবত সেই কারণেই সামগ্রিক জয় নিশ্চিত জানিবার পরও নিশ্চিন্তে থাকিবার উপায় নাই। কেহ মুচকি হাসিয়া বলিতে পারেন, রাজনীতির হাতে চিরকাল পর্যুদস্ত হওয়া অর্থনীতি একটি মোক্ষম বদলা লইয়াছে। অর্থনীতির ক্ষুদ্র যুক্তি বৃহত্তর রাজনীতির আদর্শকে সম্পূর্ণ গুলাইয়া দিতে সক্ষম হইয়াছে।

আরও পড়ুন
Advertisement