—প্রতীকী ছবি।
অনেক অনেক দিন আগেকার কথা। সেই সময়ে বাংলায় ছিল সেন রাজাদের শাসন। পাল রাজাদের সুশাসন পেরিয়ে এই ভূখণ্ডের প্রজারা তখন এক অরাজক অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। এই সময়ের বাংলার মানচিত্রের তুলনায়, সেই সময়ের বাংলা ছিল একেবারেই অন্য রকম। আজকের পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের থেকে, দ্বাদশ শতাব্দীর অবিভক্ত বঙ্গদেশ ছিল অনেক বিস্তৃত। এই অঞ্চল তখন কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল। এক দিকে সেন রাজাদের স্বেচ্ছাচার আর অন্য দিকে, লাগাতার বিদেশি শাসকদের লুঠতরাজ এবং দেশজ উচ্চবর্ণের অত্যাচারে জর্জরিত সাধারণ অসহায় আদিবাসী বাঙালি তখন বেঁচে থাকার আশ্রয় খুঁজছিল। যে আশ্রয় এক দিকে তাদের শান্তি দেবে আবার অন্য দিকে প্রতিবাদ করার, লড়াই করার সাহস জোগাবে। ক্রমে, সেন রাজাদের রাজত্ব শেষ হয়ে গেলেও, বিদেশি শক্তির লুঠতরাজ চলতেই থাকল। এই লম্বা অত্যাচারের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে, এর মধ্যে ছিল ইউরোপীয় এবং এই মহাদেশের অন্যান্য দেশের দস্যুরা। তখন এই অঞ্চলের অধিবাসী বা বাঙালিদের দেবতা ছিলেন কৃষ্ণ। আদ্যন্ত কৃষ্ণপ্রেমে আচ্ছন্ন অহিংস অসহায় বাঙালি সে সময়েই নিজেকে বাঁচানোর মাধ্যম হিসাবে এক অতিপ্রাকৃত শক্তির খোঁজ পেল। তন্ত্র-মন্ত্রের দেবী সংহার রূপীণী কালীই হলেন সেই মহাশক্তি যাঁকে আশ্রয় করে বাঙালি এক দিকে লুঠেরা বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস পেল, আবার অন্য দিকে ভয়ঙ্কর রোগভোগ এবং প্রাকৃতিক শক্তির হাত থেকে বাঁচার শক্তিও খুঁজে পেল।
শোনা যায়, ঋষি বশিষ্ঠ তন্ত্র সাধনার দেবী কালীকে চিন থেকে প্রথম এ দেশে নিয়ে আসেন। চিন থেকে উত্তর পূর্ব ভারত দিয়েই তিনি তন্ত্রসাধন পদ্ধতিকে ভারতবর্ষে নিয়ে এসেছিলেন বলে মনে করা হয়। তাই কালী মূলত উত্তর-পূর্ব ভারতের দেবী হিসাবেই জনপ্রিয় হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই উপমহাদেশের অন্যান্য প্রদেশে কালীপুজো শুরু হলেও মা কালী হলেন তন্ত্রের দেবী, যিনি উলঙ্গ, কাটা মুণ্ডমালা পরইহিতা, রক্ত চোখে খড়্গ হাতে এক ভয়ঙ্কর দেবীমুর্তি। পুরাণ বা মহাভারতে কালী মুর্তির উল্লেখ থাকলেও, এই অঞ্চলের মানুষ তামার পাত্রে আঁকা দেবী মূর্তির জঙ্গলের মধ্যে, লোক চক্ষুর আড়ালে তন্ত্রমতে পুজো করতেন। সমাজের মূল স্রোতে মা কালীর পুজো নিষিদ্ধই ছিল। পরে, কালী প্রতিমা তৈরি করে কালী পুজো শুরু হলেও সেই পুজো হতো মানুষের আড়ালে, নিভৃতে। স্বাভাবতই গৃহস্থ মানুষ এবং উচ্চবর্ণের মানুষের মধ্যে কালী পুজোর প্রচলন ছিল না। অনেক পরে এই তন্ত্রের দেবীকে প্রথম ঘরের মেয়ে হিসাবে কল্পনা করেন রামপ্রসাদ। তিনিই তন্ত্রের দেবী কালীকে ঘরের দেবী হিসাবে পুজো করতে শুরু করেন। রামপ্রসাদই প্রথম মা কালীকে বলেন, ‘বসন পরো মা পরো, বসন পরো মা’। রামপ্রসাদ শুধুমাত্র ভক্তিভাব থেকেই তন্ত্রের দেবীকে বসন পরিয়ে ঘরের দেবী করে পুজো করেছিলেন। তাঁর বিভিন্ন গানে আমরা সেই ভক্তিকে অনুভব করতে পারি কিন্তু পরবর্তীকালে কালীকে যখন বাড়িতে বা মন্দিরে আরাধনা করা শুরু হল, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র ভক্তিভাব কাজ করেনি। মনে রাখতে হবে, কালী কিন্তু শুরুতে উচ্চবর্ণ এবং অভিজাতবা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে পূজিতা ছিলেন না। অনেক সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সমাজের উচ্চতর শ্রেণির মানুষ কালীর ওই ভয়াল, ভয়ঙ্কর রূপ সহ্য করতে পারতেন না কিন্তু শক্তি হিসাবে মা কালীকে শ্রদ্ধা করতেন, তাই তন্ত্র মতের উলঙ্গ, করালবদনা ভয়ঙ্কর মূর্তি বসন পরে তথাকথিত সামাজিক হতে শুরু করে। কালীর এই রূপকে শ্যামা কালী বা ভদ্রকালী বলা হয়। কালীর রূপভেদ এবং পূজোর ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর বাড়িতে কালীপুজো শুরু করার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে কালীপুজো জনপ্রিয়তা পায়। সেই সময় থেকেই সাধারণ মানুষ, জমিদার ও উচ্চবিত্ত মানুষ নিঃসঙ্কোচে কালীপুজোর আয়োজন করতে থাকে অর্থাৎ, কালীপুজো সব অর্থেই সর্বজনীন হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, তাঁর বাড়িতে কালীপুজো শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই পুজোকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
কালীপুজোর ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিক বা সমাজতাত্ত্বিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। অনেক তত্ত্ব ও তথ্যের মধ্যে কোনটা সঠিক আর কোনটা কল্পিত সেটিও গুলিয়ে যায়। কিন্তু প্রত্যেকেই একটি ব্যাপারে সহমত যে, বাড়িতে পুজো শুরু হওয়ার আগের সব কালী মূর্তিই ছিল উলঙ্গ এবং ভয়ঙ্কর দর্শন। আজও ঘরের বা মন্দিরের কালী পুজো বাদ দিলে অন্য বেশিরভাগ জায়গাতেই কালী মূর্তি নগ্ন এবং ভয়ঙ্কর। কিন্তু, বাঙালির আশ্রয়দাত্রী আরাধ্যা দেবী মা-কালী মৌলিক রূপে নগ্ন কেন? কেন তিনি জিভ বার করে করালবদনা, হিংস্র, ভয়ঙ্কর দর্শন? এই রূপ কি নিছকই একটি কল্পনামাত্র? নাকি এর পিছনে অন্য কোনও ভাবনা আছে! একটু খোঁজখবর করা যাক।
প্রাচীন ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, বেদের সময়ে এবং তার পরবর্তীকালে যাকে আমরা বেদান্ত বা উপনিষদের যুগ বলে থাকি, সেখানে কোথাও কোনও দেব-দেবী মূর্তির অস্তিত্ব ছিল না। আমাদের আরাধ্য আজকের এই দেবদেবীদের মূর্তির আবির্ভাব হয় অনেক পরে, পুরাণের যুগে। এই সময়েই মানুষ তার কল্পনা ও দর্শনকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন শক্তিকে প্রতিমা রূপ দিতে শুরু করে, যেগুলি সবই ছিল প্রতীকী। ঐতিহাসিক জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, পুরাণের যুগে মানুষের হাতেই আজকের দেবদেবীদের জন্ম হয়।
এই দেবদেবীদের মূর্তিগুলি তৈরি হয়েছিল মূলত দর্শন, কল্পনা ও গল্পের মাধ্যমে এই পৃথিবীর নিগুঢ় রহস্য ভেদ করার উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই ভাবনারই অন্যতম নিদর্শন কালী মূর্তি। বিশ্বরহস্য সন্ধানের এক বলিষ্ঠ নজির এই কল্পিত শৈল্পিক ভাস্কর্য, যেখানে দেবদেবীর প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই দক্ষ মানুষের দার্শনিক ভাবধারার প্রতীক।
আজকের এই আড়ম্বর সর্বস্ব, উৎসবমুখী পূজাপাঠকে সরিয়ে রেখে আমরা যদি একটু গভীরভাবে কালী মূর্তির দেহ, হাত, পা, খোলা চুল বা পরণের কাটা হাত, মুণ্ডমালা ইত্যাদি সব কিছুকে একটু যত্ন নিয়ে দেখি তা হলে বুঝতে পারব, কালী মূর্তির প্রতিটি অঙ্গ ও অলঙ্কার দার্শনিক ভাবধারায় জারিত। হঠাৎ নয়, বেশ কিছু বছরের অক্লান্ত গবেষণা এবং দর্শনভিত্তিক কাহিনি তৈরি করতে করতে এই যুক্তি নির্ভর মূর্তির জন্ম হয়। অসাধারণ এই মূর্তিকে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেশ কিছু গল্পের সাহায্য নেওয়া হয়েছে, যেগুলোকেই আমরা পুরাণ বলে জানি।
দার্শনিক ভিত্তি অনুযায়ী কালী আসলে কাল বা সময়ের প্রতীক, যে সময় অসীম অনন্ত, যার কোনও আকার নেই। যে সময়ের কোনও দিক, তল বা উচ্চতা নেই, অর্থাৎ যা কিনা মানুষের মস্তিস্কের সাধারণ ধারণ ক্ষমতার বাইরে। দার্শনিকদের মতে, সেই নিরাকার অনন্ত ব্রহ্মকে সাধারণের বোধগম্য করার একান্ত প্রচেষ্টা থেকেই আবরণহীন কালী মূর্তির আবির্ভাব। তাই, কালীর গায়ের রঙ কালো বা গাঢ় নীল, যা কিনা শূন্যতার প্রতীক। যে শূন্যতাই এই বিশ্বের একমাত্র সরল, স্বাভাবিক সত্য। গাঢ় নীল বা কালো রং দিয়ে সেই অসীমকেই বোঝানো হয়েছে, যে অসীমকে নজরুল ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর গানে, ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা রে আলোর নাচন’। সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে হলেও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর’।
চতুর্ভূজা দেবীর চারটি হাতের মধ্যে দুই হাতে থাকে বরাভয় এবং আশীর্বাদ। এই আশীর্বাদ সাহস জোগায়। মানুষ বেঁচে থাকার সাহস পায়, অন্যদেরও বাঁচিয়ে রাখে। মা-কালীর অন্য দুই হাতে থাকে খড়্গ এবং কাটা মুণ্ড। এই খড়্গের সাহায্যে দেবী অজ্ঞানতাকে হত্যা করে জ্ঞানের জন্ম দেন। মানুষের মস্তক হলো জ্ঞানের আধার, এই ধারণা থেকেই কাটা মস্তক হাতে নিয়ে দেবী অজ্ঞান মস্তিষ্কে বিশেষ জ্ঞান দান করার চেষ্টা করেন। দেবীর লাল জিভ সাদা দাঁত দিয়ে চেপে থাকার অর্থ, ত্যাগের মাধ্যমে ভোগকে দমন করার নিরন্তর চেষ্টা, অর্থাৎ জিভকে দাঁত দিয়ে চেপে রেখে তিনি মানুষকে জীবনের প্রকৃত অর্থ খোঁজার নির্দেশ দেন, যেখানে ত্যাগই হল প্রকৃত শক্তি। কালী মূর্তির গলায় পঞ্চাশটি কাটা মুণ্ড থাকে, যা পঞ্চাশটি বর্ণ অর্থাৎ ভাষার প্রতীক, যে ভাষার মাধ্যমেই মানুষ জ্ঞানের প্রকাশ ঘটাতে পারে। কোমরে ঝোলানো কাটা হাতের কোমরবন্ধনী আসলে কর্মের চিহ্ন, যে কর্মের মাধ্যমে মানুষ জীবনধারণ করতে পারে। কর্ম যেহেতু মূলত হাত দিয়েই করা হয়, সেহেতু হাতের কোমরবন্ধনী। কালী মূর্তির তৃনয়ন আলোর প্রতীক। এই পৃথিবীতে আলো মূলত তিনটি উৎস হতে আসে— সূর্য, চন্দ্র এবং অগ্নি। এই আলোই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আবার জ্ঞান বলতেও আলো বোঝায়।
এই পৃথিবীর অস্তিত্ব সাধারণ ভাবে দু’টি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল, যার একটি হল স্থিতি আর একটি হল গতি। এই দুইয়ের গাণিতিক বিক্রিয়ায় সৃষ্টি সচল থাকে। কালী প্রতিমা সম্পূর্ণ রূপ পায় শিবের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে। এখানে শিব স্থিতির প্রতীক আর কালী গতির, অর্থাৎ, কালী মূর্তির পায়ের তলায় শিব-রূপী সময়কে বাঁধার বা ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে শিব স্থিতির প্রতীক আর কালী গতির অর্থাৎ, শিব-রূপী অনন্ত, যাঁর কোনও অনুভূতি নেই, সত্তা নেই। প্রথাগত সাধারণ জ্ঞান দিয়ে যাকে ধরা যায় না, সময়ের মারপ্যাঁচে যাকে বাঁধাও যায় না। যার কাছে সৃষ্টি, স্থিতি, লয় সব কিছুই সমান, সেই সচ্চিদানন্দ নিরাকার নির্গুণ ভাবনাই এই মূর্তিতে শিব রূপে ধরা পড়ে। এ ভাবেই স্থিতি ও গতির দোলাচলে পৃথিবী চলমান।
এমনই দার্শনিক ভাবনা থেকে জনমানসে কালী মূর্তির আবির্ভাব হয়েছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে এক অসাধারণ তাত্ত্বিক ভাস্কর্যকে একটি মূর্তির মাধ্যমে মানুষের কাছে ঈশ্বর করে তোলার পিছনে সমাজগঠনের পরিকল্পিত লক্ষ্যই কাজ করেছিল। কিন্তু আজ সেই লক্ষ্যই উপলক্ষ হয়ে সমাজজীবনের পিছনের সারিতে। বর্তমানে, মানুষের কাছে আড়ম্বর সর্বস্ব মেকি পূজাচারই ধর্ম, যেটি কালক্রমে মানুষের কাছে একটা দায় হয়ে উঠেছে, উঠছে। মূল্য ধরে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে সেই দায়মুক্ত হই। আজকের এই ধর্মীয় আভরণ-সর্বস্ব পুজাচার কতটা মানুষের মঙ্গল ঘটায়, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায় কারণ আজকের ধার্মিকরা পুজোর আড়ম্বরের মধ্যেই ধর্ম খোঁজেন, ফলে কালী মূর্তি বা অন্যান্য আরও দেবদেবীর মূর্তির ভাবনাকে ঘিরে যে দর্শন বা সমাজতত্ত্ব কাজ করেছিল সেটাই মূল্যহীন হয়ে পড়ে। সুদূর অতীতে মৃন্ময়ী মূর্তিকে মাধ্যম করে দার্শনিক ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব-রহস্য সমাধান করার যে প্রক্রিয়া চলেছিল, সেখানে যুক্তি-তর্কের অবকাশ থাকলেও, দার্শনিক সদিচ্ছার অভাব যে ছিল না সেটা ইতিহাস ঘাঁটলেই বোঝা যায়, তাই হয়তো আজও কালী মূর্তি বসন না পরে নগ্ন হয়েই পূজিত।
ঋনস্বীকার:
ধর্মের ভবিষ্যৎ, জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, এলাইড পাবলিশার্স, প্রথম প্রকাশ, জুন ১৯৯৫
ভারতের সাধক, শঙ্করনাথ রায়, করুণা প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ, ভাদ্র ১৩৫৫
মধ্যযুগের ধর্মভাবনা ও বাংলা সাহিত্য, শম্ভুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, পুস্তক বিপণি, প্রথম প্রকাশ, জুলাই ১৯৯৪
বাঙালির ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়, দে’জ পাবলিশিং, ১৩৫৬