শিক্ষাব্যবস্থার সহিত বাজারের চাহিদা-জোগানের সম্পর্ক রহিয়াছে বটে, কিন্তু দ্বিতীয়টিকেই প্রথমটির চালিকাশক্তি ধরিয়া লওয়া ঠিক কি না, প্রশ্ন উঠিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আবার সেই প্রশ্নটি উঠাইল। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ছাত্রছাত্রীদের চাহিদাভিত্তিক পাঠ্যক্রম পড়াইবার প্রস্তাব দিয়াছে কমিশন। অর্থাৎ, কোনও পাঠ্যক্রমের চাহিদা থাকিলে তবেই তাহা চালু রাখা বিধেয়, নচেৎ নহে। ইহা সত্য যে, চাকুরি বাজারে সম্ভাবনা দেখিয়াই পাঠ্যক্রম বাছিয়া লন অধিকাংশ পড়ুয়া। উহা জরুরিও বটে, তবে তাহা বিদ্যাচর্চার যুক্তি নহে। পড়াশোনা হইল জ্ঞান উৎপাদন প্রক্রিয়া। যাহা বিদ্যার্থীর চিন্তানুশীলন ও উদ্ভাবক মনটি প্রস্তুত করে, তাহার পশ্চাৎপট এতাদৃশ সঙ্কীর্ণ হইতে পারে না। অতএব, চাকুরি বাজারে আকাশপাতাল ফারাক সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন এবং অর্থনীতির পাঠ্যক্রম সমান গুরুত্ব সহকারে পড়ানোর কিছু সারস্বত যুক্তি থাকিবার কথা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন সেই যুক্তির কথা তুলিয়াছে, বলিয়াছে, উক্ত প্রস্তাব মানিলে একাধিক ভাষা এবং সমাজবিজ্ঞানের বিষয়সমূহের ক্ষতি হইতে পারে।
কেবল ভারতে নহে, সমগ্র পৃথিবীতেই এখন এই প্রশ্নটি সামনে আসিতেছে, এবং ক্রমশ জটিলতর হইতেছে। আমেরিকা কিংবা ইংল্যান্ডের মতো দেশেও সম্প্রতি কিছু হিউম্যানিটিজ় বা মানববিদ্যা বিষয়ে বিভাগ কমিতেছে, উচ্চশিক্ষা বা গবেষণার লক্ষ্যে গ্রান্ট কিংবা অন্যান্য ব্যয়ের পরিমাণ কমিতেছে। এ কথা ঠিক যে, যে কোনও দেশেই যোগ্য চাকুরিপ্রার্থী প্রস্তুত করিবার একটি দায় শিক্ষাব্যবস্থাকে বহন করিতে হয়। ইহাও ঠিক যে, ভারতের মতো দেশে ইহা সঙ্কটবিশেষ— উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজনানুপাতে চাকুরিপ্রার্থী তৈরি করিতে পারে না। দেশের শিক্ষাকর্তাদের তাহা লইয়া চিন্তা করিতে হইবে, আপনাদের আরও প্রস্তুতও হইতে হইবে। কিন্তু তাহা বলিয়া বিদ্যাচর্চার উৎকর্ষ এবং বাজারের ভিতর কোনও ফারাক থাকিবে না— ইহা কি সঙ্গত? শিক্ষার সিদ্ধি কি কেবলই চাকুরিতে? সামাজিক উন্নয়ন ও সভ্যতার অগ্রগমনের জন্য কি শিক্ষার উৎকর্ষ-লক্ষ্য বজায় রাখা জরুরি নহে? আবশ্যিক পাঠ্যক্রমের সহিত স্বাধীন লেখাপড়া না মিশাইলে মানুষ গড়িবার প্রক্রিয়াটিই অসম্পূর্ণ থাকে। প্রয়োজনের গণ্ডিতে রুদ্ধ থাকা মানুষের স্বধর্ম নহে, উহাতে মনের বৃদ্ধির ক্ষতি। রবীন্দ্রনাথ এক বার বলিয়াছিলেন, আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাত, কিন্তু তাহা বলিয়া ঠিক সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে আমাদের চলে না।
ভারতের বর্তমান শাসকরা অবশ্য শিক্ষার লাভ-ক্ষতিটিও ভাল করিয়া জানেন না। মোদী সরকারের আমলে গবেষকদের বৃত্তিতে প্রবল কাটছাঁট হইয়াছে, বিজ্ঞানের প্রয়োগগত বা ‘প্র্যাক্টিক্যাল’কে তাহার তত্ত্বগত বা ‘থিয়োরেটিক্যাল’ শাখা অপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়া অনর্থ ঘটিয়াছে। সমাজবিজ্ঞানে খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ আসন হ্রাস পাইয়াছে। ইহা কেবল প্রায়োগিক শিক্ষার বিষয় নহে, নাগপুরের একশৈলিক চিন্তাধারায় যেটুকু খাপ খায়, শুধু সেটুকুকেই শিক্ষা বলিয়া মানিবার ও প্রচার করিবার উদ্যোগ। দুর্ভাগ্য ক্রমশ জমাট বাঁধিতেছে। শিক্ষার পরিসরটি ধ্বস্ত হইতেছে।