ভারতীয় অর্থব্যবস্থার চলন দেখিয়া পশ্চিমবঙ্গের ভূতপূর্ব অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র সংশয় প্রকাশ করিয়াছেন, দেশ ‘স্ট্যাগফ্লেশন’-এর পথে চলিতেছে কি? অর্থশাস্ত্রের পরিধিতে এই শব্দটি অন্যতম ভীতিপ্রদ। তাহার এক দিকে রহিয়াছে ‘স্ট্যাগনেশন’— অর্থাৎ আর্থিক বৃদ্ধির হারের গতিভঙ্গ; অন্য দিকে ‘ইনফ্লেশন’, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি। এবং, দুইয়ের সহিত লগ্ন হইয়া থাকে উচ্চ বেকারত্বের হার। পরিসংখ্যান দেখিলে আশঙ্কাটি দৃঢ়তর হইতে বাধ্য। নভেম্বর মাসে ভারতে পাইকারি মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৪.২২ শতাংশ। আট মাস যাবৎ এই হার দশ শতাংশের ঊর্ধ্বে থাকিয়াছে, যাহা প্রবল উদ্বেগের কারণ। অন্য দিকে, বেকারত্বের হারও ফের মাথা তুলিতেছে— ডিসেম্বরে এই হার আট শতাংশ ছুঁইয়া ফেলিল। কেহ বলিতে পারেন বটে যে, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৮.৪ শতাংশ হইয়াছে, ফলে চিন্তার কারণ নাই— কিন্তু স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয়, এই বৃদ্ধি ঘটিয়াছে ২০২০ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের কোভিড-বিধ্বস্ত অর্থব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। হিসাব বলিতেছে যে, বহু চেষ্টায় ভারত সবেমাত্র প্রাক্-কোভিড স্তরে ফিরিয়া আসিতে পারিয়াছে। ২০১৯-পরবর্তী দুইটি বৎসর সম্পূর্ণই হারাইয়া গিয়াছে। ফল, ত্র্যহস্পর্শ— আর্থিক বৃদ্ধি ভগ্নগতি, মূল্যস্ফীতির হার বিপজ্জনক ভাবে ঊর্ধ্বমুখী, এবং বেকারত্বের হারও আশঙ্কাজনক। মহাকবি সাক্ষ্য দিবেন, ইহাকে ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ বলা হউক বা ‘হৃদয়হরণ’, ভয়ের কারণ বিলক্ষণ আছে।
কাহারও মনে প্রশ্ন জাগিতে পারে যে, গত সাড়ে সাত বৎসর ভারতীয় অর্থব্যবস্থা যে ভঙ্গিতে পরিচালিত হইয়াছে, তাহার পরও কি নূতন ভয়ের কারণ থাকিতে পারে? তাহা পারে বটে। স্ট্যাগফ্লেশন তেমনই একটি ভয়ের কারণ। ইহা শুধুমাত্র দুইটি ব্যাধির সংযুক্ত রূপ নহে, ব্যাধি দুইটির চিকিৎসা চরিত্রে বিপরীতমুখী। অর্থাৎ, আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়াইতে গেলে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়িয়া যাওয়ার আশঙ্কা; মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরাইতে গেলে আর্থিক বৃদ্ধির গতিভঙ্গ হইবার ভয়। দুইটি ব্যাধিই যে হেতু অর্থব্যবস্থার পক্ষে প্রাণঘাতী, ফলে নীতিনির্ধারকদের হাত বাঁধা পড়িয়া যায়। সুদের হার কমাইয়া বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার যে আর্থিক নীতিটি নরেন্দ্র মোদী সরকার গত দেড় বৎসর যাবৎ অনুশীলন করিতেছে, স্ট্যাগফ্লেশনের মুখে তাহা শুধু ভোঁতাই নহে, বিপরীতফলদায়ী। অন্য দিকে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আর্থিক নীতি গ্রহণ করিলে তাহা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহ করিবে। অতীতে একাধিক উন্নয়নশীল দেশ স্ট্যাগফ্লেশনের কবলে পড়িয়া সম্পূর্ণ কক্ষচ্যুত হইয়াছে। ফলে, অমিত মিত্রের সতর্কবাণীকে উড়াইয়া দেওয়া চলে না।
বেসরকারি লগ্নি যে নাই, তাহা কেন্দ্রীয় সরকারই কার্যত স্বীকার করিয়া লইয়াছে। অর্থ মন্ত্রক বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পকে ‘ফ্রন্টলোডিং’ করিবার কথা বলিয়াছে। অর্থাৎ, সরকারি ব্যয়কেই সরকার উদ্ধারের পথ হিসাবে বিবেচনা করিতেছে। কিন্তু, সেই পথেও একটি অলঙ্ঘ্য বাধা রহিয়াছে, যাহার নাম রাজকোষ ঘাটতি। ফলে, যথেচ্ছ খরচ করিবার উপায় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নাই। এই পরিস্থিতিতে বিবেচনা করা প্রয়োজন, কোন পথে টাকা খরচ করিলে তাহা সর্বাপেক্ষা কার্যকর হইবে। অমিত মিত্র প্রস্তাব করিয়াছেন, প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের পন্থাটিই সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য। মানুষের হাতে ব্যয় করিবার মতো টাকার সংস্থান হইলে অর্থব্যবস্থায় চাহিদা ফিরিবে। ফলে, অতি শিথিল আর্থিক নীতি গ্রহণ না করিলেও শিল্পক্ষেত্রে লগ্নি আসিবে, তেমন সম্ভাবনা আছে। কিন্তু, মূল প্রশ্ন হইল ভারসাম্য বজায় রাখা। আর্থিক বৃদ্ধি বনাম মূল্যবৃদ্ধির এই খেলায় যাহাতে দুই দিকের কথাই গুরুত্ব পায়, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের।