Hatred

ধারাবাহিক ঘৃণা

উদ্বেগের কথা হল, আমাদের আইন বা বিচারব্যবস্থাও এই ঘৃণ্য বাগাড়ম্বরকে যথাযোগ্য বিধান দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৫০

উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতি যে আইনশৃঙ্খলাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না, দেশে-দেশে তার প্রমাণ বিরল নয়, ভারতে তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ যতি নরসিংহানন্দ। গত বছর ডিসেম্বরে হরিদ্বারের ধর্ম সংসদে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসামূলক মন্তব্যের কারণে গ্রেফতার হয়েছিলেন গাজ়িয়াবাদের ডসনা দেবী মন্দিরের এই প্রধান পুরোহিত। জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও দিল্লির হিন্দু মহাপঞ্চায়েতে একই রকম বিষ ছড়িয়েছেন তিনি। উল্লেখ্য, এ দিনের সংগঠকেরা গত বছর অগস্টে যন্তর মন্তরে যে জমায়েত করেছিলেন তাতেও মুসলমান-বিরোধী ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল। গত এক বছরে এই সমস্ত আয়োজনে এক নির্দিষ্ট প্রচার-নকশা ফুটে উঠছে— ‘অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ’, ‘ধর্মান্তরণ নিয়ন্ত্রণ’ ও ‘দেবস্থান মন্দির মুক্তি’— এক বৃহত্তর ও নিরবচ্ছিন্ন উগ্র সাম্প্রদায়িক আখ্যান। যদি আইনের পথে দ্রুত একে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তা হলে সমাজে যে বিভাজন তৈরি হয়ে যাবে তাতে সভ্যতাবিরোধী এই শক্তিগুলিই আরও বেশি করে নির্ণায়ক হয়ে উঠবে। তেমন অন্ধকার দিন হয়তো দেশবাসী এখনও কল্পনাও করতে পারেন না।

উদ্বেগের কথা হল, আমাদের আইন বা বিচারব্যবস্থাও এই ঘৃণ্য বাগাড়ম্বরকে যথাযোগ্য বিধান দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। নরসিংহানন্দের জামিনের শর্তে বলা ছিল যে, তিনি এমন কোনও জমায়েতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না, যা ‘নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার লক্ষ্যে আয়োজিত’। প্রশ্ন হল, তিনি তা পারলেন কী করে? দ্বিতীয় বার আইনভঙ্গ করার পরেও এত দিনে এফআইআর ছাড়া আর কিছুই হল না কেন? কেন তিনি এখনও কুমন্তব্য করেই চলেছেন? এমন বিভাজনকামী জমায়েতই বা অনুমতি পায় কী ভাবে? এ কথা ঠিক যে, রাষ্ট্রীয় শাস্তিবিধানকে মাথার ভূষণ করে নেওয়াই উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ধর্ম— তাতে নিজেদের ষড়যন্ত্রের শিকার হিসাবে চিহ্নিত করা যায়, ঘৃণামূলক আখ্যানকে মান্যতা দেওয়া যায়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বা বিচারব্যবস্থা ছাড়া আর কারও পক্ষে এই ঘৃণার প্রচারস্রোতে লাগাম পরানো সম্ভবও নয়। সুতরাং, তারা সক্রিয় না হলে সমাজে এক ক্ষতের সৃষ্টি হয়, যা অচিকিৎস্য।

Advertisement

শেষাবধি যে হেতু রাজনীতির ভূমিকাই সর্বব্যাপী, অতএব সেই প্রসঙ্গ ব্যতিরেকে সমস্যাটি বোঝা যাবে না। গত আট বছরে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি যে ভাবে প্রান্ত থেকে ক্রমশ মূলস্রোতে চলে আসছে, তাতে কেন্দ্রীয় শাসক দলের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকাটি অগ্রাহ্য করা যায় না। এক দিকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক রামমন্দিরের ভূমি পূজন অথবা কাশী বিশ্বনাথ করিডর উদ্বোধনে গঙ্গাস্নান, অন্য দিকে নবরাত্রির সময় বিজেপি পরিচালিত একাধিক পুরসভা কর্তৃক আমিষ খাদ্য বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা— হিন্দুত্ববাদের প্রচার-প্রসারকে এ ভাবেই রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছে শাসকগোষ্ঠী। সেই উপলব্ধিকে প্রবলতর করেছে গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকাণ্ডে সরকারপক্ষের নীরবতা অথবা একাধিক গণপিটুনিতে প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। স্বভাবত, এর ফলেই শক্তি পেয়ে চলেছে প্রান্তীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলি। বাস্তব বলবে, হরিদ্বার বা দিল্লিতে সংঘটিত ঘৃণামূলক প্রচার বস্তুত ধারাবাহিকতা, কোনও ব্যতিক্রম নয়। বহুত্ববাদী ভারত যে ক্রমশ একশৈলিক হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র হয়ে উঠছে, যতি নরসিংহানন্দরা তারই অভিজ্ঞান।

আরও পড়ুন
Advertisement