বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা মানেই পড়াশোনা নয়। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে সারা সপ্তাহ ধরে বেশি সময় কাটানো মানেও কি বেশি শেখা? ২০২০-র জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসরণে চার বছরের স্নাতক পাঠক্রম শুরু হয়ে গিয়েছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা তাদের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও উত্তর আমেরিকার সমস্তরী ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় ক্লাসে থাকছে অনেকটা বেশি সময়। বিদেশে যেখানে সিমেস্টার-পিছু মোটামুটি ভাবে চারটি কোর্স এবং কোর্স-পিছু সপ্তাহে তিন ঘণ্টার ‘ক্লাসরুম লেকচার’ বরাদ্দ, সেখানে ভারতে চার বছরের স্নাতক পাঠক্রমে পড়ুয়াদের সিমেস্টার-পিছু পাঁচটি কোর্স নেওয়া ও কোর্স-পিছু সপ্তাহে চার ঘণ্টার লেকচারে যোগদান বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ বিদেশে যেখানে প্রতি সপ্তাহে বারো ঘণ্টা, ভারতে সেখানে কুড়ি ঘণ্টার ক্লাসরুম লেকচার। অভিভাবকেরা ভাবতে পারেন: হাজার হোক উচ্চশিক্ষা, কোর্স ও ক্লাসের সময় দুই-ই তো বেশি হবেই, হওয়া দরকারও।
তবে বেশি সময় ধরে শ্রেণিকক্ষে বসিয়ে পড়ালেই যে ‘শিক্ষা’ হয় না, এই কথাটিও উঠে আসছে শিক্ষামহলে। উচ্চশিক্ষা, শিক্ষণ প্রক্রিয়া, শিক্ষার্থীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন যাঁরা, তাঁদের মতে এতে যে খুব ভাল হবেই তা বলা যাচ্ছে না। বরং, অনেক কিছু হচ্ছে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না— থেকে যাচ্ছে এই ঝুঁকিটিও। উচ্চশিক্ষা শুধুই ক্লাসরুমে হয় না, ক্লাসের বাইরেও নানা রকম ভাবে শেখার প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে। অতিরিক্ত কোর্স ও লেকচারের বাধ্যবাধকতায় পড়ুয়াদের ক্লাসরুমে বসিয়ে রাখলে ক্লাসের বাইরের জরুরি ‘অ্যাকাডেমিক’ কাজগুলি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা: নিজে নিজে পড়া ও ভাবা, অনুসন্ধান ও গবেষণা, অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির প্রয়োজনীয় সময়টুকু কমে যাবে নিঃসন্দেহে। এ দিকে শিক্ষানীতি বলে চলেছে ‘কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট’-এর কথা, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আগেকার ‘চয়েস-বেসড ক্রেডিট সিস্টেম’ (সিবিসিএস) ব্যবস্থায় তার সুযোগ ছিল বেশি, এখন অতিরিক্ত সময় ক্লাসরুমে থাকার কারণে কোর্স-প্রতি দু’টির বেশি মূল্যায়নের সময় বা সুযোগ কোনওটাই পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবেই, মূল্যায়নের চরিত্রও যাচ্ছে বদলে, টার্ম পেপার বা গবেষণা-নিবন্ধ লেখার পরিবর্তে ছেয়ে যাচ্ছে ‘মাল্টিপল চয়েস’ প্রশ্নভিত্তিক মূল্যায়নের প্রবণতা।
এই সবই জানা ও বোঝা দরকার অবিলম্বে: আজ যা প্রবণতা, কাল তা অভ্যাসে পরিণত হওয়ার আগেই। ক্লাসরুমে বেশি সময় কাটানোয় সত্যিই উচ্চশিক্ষার কোনও লাভ হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নটি তোলা দরকার। স্কুলশিক্ষার সঙ্গে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার একটি মূলগত ফারাক আছে— স্কুলশিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কটি মুখ্যত দাতা ও গ্রহীতার, শিক্ষকই সেখানে ‘জ্ঞান’-এর অধিকারী ও প্রচারক। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সম্পর্কের এই সমীকরণটি পাল্টে যায়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কেবলই অনুগত ও নিষ্প্রশ্ন গ্রহীতা ভেবে নিলে চলে না। ক্লাসের বাইরেও তাদের যথেষ্ট সময় দেওয়া দরকার— পাঠ নিয়ে ভাবার, পরিকল্পনা করার, তা কাজে লাগানোর: কখনও গবেষণা-নিবন্ধ লিখে, কখনও গ্রুপ স্টাডি বা প্রোজেক্ট করে, নিজের পাঠ-পরিসরের বাইরে গিয়ে তুলনামূলক আলোচনার। এই সব কিছু না করে স্রেফ ক্লাসে বসিয়ে পড়ানো শিক্ষকদের কাজ নয়, কোনও কাজের কথাও নয়— শিক্ষা প্রশাসক ও নিয়ামকদের কাছে এই কথাটি পৌঁছে দেওয়া চাই।