পাহাড়ের ঢালে কোথাও চাষ হইতেছে জাফরান, কোথাও লাগানো হইতেছে আখরোট গাছের চারা। ড্রাগন ফ্রুট হইতে খরিফ মরসুমের পেঁয়াজ, পশ্চিমবঙ্গে এমন অনেক কৃষিপণ্যেরই চাষ চলিতেছে, যাহা এই রাজ্যের জল-মাটির নিজস্ব নহে। কৃষিতে বৈচিত্র আনিবার এই নীতিটিকে স্বাগত জানানোই বিধেয় হইত, যদি না রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী জানাইতেন যে, তাঁহাদের মূল উদ্দেশ্য পশ্চিমবঙ্গকে ‘স্বনির্ভর’ করিয়া তোলা। পশ্চিমবঙ্গকে বহুবিধ কৃষিপণ্য ভিন্রাজ্য অথবা দেশ হইতে আমদানি করিতে হয়। মন্ত্রিবর জানাইয়াছেন, সেই পণ্যগুলির উপর জোর দিতেছে রাজ্য সরকার, যাহাতে রাজ্যের উৎপাদন হইতেই রাজ্যের প্রয়োজন মিটিয়া যায়, এমনকি রফতানি করিবার মতো উদ্বৃত্ত পণ্যও হাতে থাকে। মন্ত্রিমহোদয়ের পরিকল্পনাকে তারিফ করিবার পথে বাধা হইয়া দাঁড়াইবে অর্থশাস্ত্রের দুই শতাব্দীপ্রাচীন একটি তত্ত্ব। তাহা বলিবে, যে পণ্য উৎপাদনে কুশলতা অন্য উৎপাদকের তুলনায় কম, সেই পণ্য বর্জনীয় তো বটেই; এমনকি দুইটি পণ্য কুশলতা থাকিলেও যাহাতে অধিকতর কুশলী, সেই পণ্য উৎপাদন করাই বাঞ্ছনীয়। উৎপাদনের প্রশ্নে মনস্থির করিবার দ্বিতীয় কোনও পন্থা নাই। অত্যাবশ্যক নহে, এমন কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে ‘স্বনির্ভর’ হইয়া উঠিবার সাধনা সামর্থ্যের অপচয় ভিন্ন আর কিছুই নহে।
বস্তুত, বাজার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠাই হইয়াছে এই ‘স্বনির্ভরতা’-র যুক্তির সমাধির উপরে। সভ্যতার আদিপর্বে নিজের প্রয়োজনের যাবতীয় সামগ্রীই মানুষকে উৎপাদন করিয়া লইতে হইত— কখনও ব্যক্তি হিসাবে, কখনও কোনও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে। বিনিময় করিতে শেখা, এবং মুদ্রাব্যবস্থার উদ্ভাবন মানুষকে সেই বাধ্যবাধকতা হইতে মুক্তি দিয়াছে। যে ব্যক্তি যে কাজটি করিতে দক্ষ, কুশলী এবং ইচ্ছুক, বাজার ব্যবস্থা তাহাকে সেই কাজটি করিবার স্বাধীনতা দিয়াছে। অন্যান্য পণ্যের প্রয়োজন মিটাইয়াছে বিনিময়— প্রথমে পণ্যের বিনিময়, পরে অর্থের বিনিময়। তাহাই সভ্যতাকে গতিশীল করিয়াছে। যুগ বদলাইয়াছে, কিন্তু এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সত্যটি অপরিবর্তিত। রাজ্যের প্রয়োজন মিটাইবার জন্য রাজ্যেই উৎপাদনের দরকার নাই। বরং, পশ্চিমবঙ্গ যে পণ্য উৎপাদনে পারদর্শী, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের আপেক্ষিক দক্ষতা রহিয়াছে, তেমন পণ্য উৎপাদনে জোর দিলেই মঙ্গল। তাহাতে যে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব, সেই টাকায় অন্যান্য পণ্য আমদানি করিতে সমস্যা হইবে না।
কোনও নূতন পণ্য উৎপাদনে দক্ষতা অর্জন করিতে চেষ্টা করা কি ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত? কোনও মতেই নহে। বস্তুত, মূল্যশৃঙ্খলের ধাপ বাহিয়া উঠিবার একটি পরিচিত পথ হইল নূতনতর, মহার্ঘতর পণ্য উৎপাদন করিতে শিখা। পশ্চিমবঙ্গও বিলক্ষণ সেই কাজ করিতে পারে। সত্যই যদি মহার্ঘতর কৃষিপণ্য উৎপাদন করিয়া তাহার রফতানির ব্যবস্থা হয়, তাহা রাজ্যের অর্থব্যবস্থার উপকার করিতে পারে। কিন্তু, গোড়ায় উদ্দেশ্য বিষয়ে সচেতন হওয়া বিধেয়। স্বনির্ভরতা নহে, উৎপাদনকে আর্থিক ভাবে আরও কুশলী করিয়া তোলাই সরকারের উদ্দেশ্য হউক। নূতন পদ্ধতি শিখিবার ও শিখাইবার ব্যবস্থা হউক, কৃষিবান্ধব পরিকাঠামো নির্মিত হউক। কিন্তু, কুশলতা অর্জন করিতে না পারিলেও স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে অর্থব্যয় করিয়া চলিতে হইবে, এই জেদটি পরিত্যাজ্য।