গত বছরটি শেষ হয়েছিল দুর্ঘটনার খবর দিয়ে। মানিকতলা থানার তেলেঙ্গাবাগানে দু’টি বাসের রেষারেষির সময় বেপরোয়া বাসের চাকা উঠে গিয়েছিল রাস্তা পেরোতে চাওয়া এক প্রৌঢ়ার পায়ের উপর। সেই রক্তাক্ত অবস্থাতেই অনেক ক্ষণ পড়ে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। এই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই বাগুইআটিতে বাসের ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে এক অ্যাপ-বাইক চালকের। গুরুতর জখম হয়েছেন আরোহী তরুণী। তবে নতুন বছরে এখনও অবধি সর্বাধিক মর্মান্তিক ঘটনাটি দক্ষিণ কলকাতার জুবিলি পার্কের কাছে তেলের ট্যাঙ্কারের ধাক্কায় এক মহিলা পুলিশকর্মীর মৃত্যু। বাইকের চাকা পিছলে যাওয়ায় রাস্তায় ছিটকে পড়া এএসআই-কে পিষে দেয় তেলের ট্যাঙ্কারটি।
পর পর ঘটা দুর্ঘটনাগুলি নাগরিক মনে ভয় ধরায়। কাজ-শেষে সুস্থ, অক্ষত শরীরে বাড়ির নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ফিরে আসাটাই যখন অনিশ্চিত, তখন এই ভয় যুক্তিসঙ্গত। দুর্ঘটনার সংখ্যাধিক্য রোধ করতে রাজ্য সরকার নানাবিধ পরিকল্পনার কথা ইতিমধ্যেই জানিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম বেপরোয়া বাসচালকদের নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু তাতে লাভ হয়েছে কতটুকু? সম্প্রতি পরিবহণ দফতর জানিয়েছে এক বিশেষ অ্যাপ চালুর কথা, যার মাধ্যমে বাসচালকদের উপর নজরদারির কাজটি চালানো যাবে। একই সঙ্গে একটি আদর্শ আচরণবিধিও চালু করা হবে, যার মাধ্যমে চালকদের বাস চালানো, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া-সহ নানা নির্দেশিকা দেওয়া থাকবে। এ সব দাওয়াইয়ের কথা এর আগেও নানা মোড়কে আলোচিত হয়েছে। প্রশ্ন হল, কলকাতার মতো জনবহুল শহরে বাসচালকদের বেপরোয়া আচরণ নতুন নয়। তা হলে আরও আগেই কেন পদক্ষেপ করা হল না? দীর্ঘ দিন ধরেই প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি ছিল বেসরকারি বাস রেষারেষির মতো ভয়ঙ্কর মানসিকতার পিছনে কাজ করছে কমিশন প্রথা। অথচ, বাসমালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন প্রথা তুলে দেওয়ার সরাসরি নির্দেশটি দেওয়া হল সম্প্রতি সল্ট লেকের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর, যেখানে দু’টি বাসের রেষারেষির কারণে মায়ের স্কুটার থেকে পড়ে এক স্কুলপড়ুয়ার মৃত্যু হয়। এর আগে এ নিয়ে আলোচনা হলেও কমিশন প্রথায় লাগাম টানা যায়নি, ভবিষ্যতেও যে যাবে, তেমন আশা কম।
গত বছর শহরে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দিয়ে কলকাতা পুলিশের তরফে জানানো হয়েছিল, সমস্ত দুর্ঘটনার ৩৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও বাস জড়িত। প্রসঙ্গত, গত কয়েক বছরে অধিক রাতে শহরে ব্যক্তিগত গাড়ির বেপরোয়া গতির শিকারও অনেকে হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই প্রভাবশালী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাঁদের ক’জনের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য ব্যবস্থা করা হয়েছে? রাতের শহরে পুলিশি নজরদারির খামতির যে অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়, তার ব্যবস্থাই বা সরকার কোন পথে করবে? সর্বোপরি, কলকাতার জনসংখ্যা এবং গাড়ি চলাচলের সংখ্যার অনুপাতে রাস্তার পরিমাপ অত্যন্ত কম। গাড়ি চলাচলের রাস্তার উপরেই বাজার, দোকান, ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়। জনবহুল রাস্তার মোড়ে ট্র্যাফিক পুলিশের দেখাও সব সময়ে মেলে না। এই সমস্ত কিছুর সম্মিলিত ফলই একের পর এক দুর্ঘটনা। এই সামগ্রিক চিত্র পাল্টাতে বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপে কাজ হবে না। দরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং আইনের কার্যকর প্রয়োগ। তবে, তার চেয়েও বেশি দরকার প্রশাসনিক সদিচ্ছা। তার অভাব আদৌ কাটবে তো?