Holi

দোলযাত্রাপথ

একশো বছর পর কি বাঙালির মধ্যে সেই বসন্তসুন্দর উদ্‌যাপনের মানসিকতা কিছুমাত্র অবশিষ্ট আছে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২২ ০৬:৩০

শতবর্ষের সিলমোহর পড়ল বাঙালির দোলেও। যে দোল হোলি নয়, যে দোলের আর এক নাম বাংলায় বসন্তোৎসব। যে দোল হিন্দুপুরাণ বা পূর্ব মীমাংসা সূত্র বা হর্ষবর্ধনের রত্নাবলীর হোলিখেলা নয়, হিরণ্যকশিপু ও প্রহ্লাদকাহিনির হোলিকাদহন নয়, যে দোলে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা আছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি কিছু আছে, যে দোলে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মগ্রহণের উৎসব আছে, কিন্তু তারও চেয়ে অনেক বড় কোনও সাধনা আছে— বাঙালির সেই ‘বসন্তোৎসব’ দোল একশো বছরে পড়ল, এমন একটি দাবি তোলাই যায়। বাঙালির এই অতি নিজস্ব দোলটির উৎস বলে শান্তিনিকেতনকেই ধরতে হবে। অবশিষ্ট ভারত একে চেনে না, চিনলেও জানে না, জানলেও এর কদর করে না। এর মধ্যে হোলিকাদহনের আদলে কুশপুতুল পোড়ানো বা নেড়াপোড়া আছে, বৈষ্ণব আকুলতায় স্নেহপ্রেমপ্রীতির অনাবিল অনর্গল ধারা আছে, ভক্তিগীতির আসর আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি করে আছে ‘ওরে গৃহবাসী খোল্ দ্বার খোল্’-এর ডাক। সকলে মিলে একজোট হয়ে বসন্তের আরাধনা আছে, নবপল্লবদলের উদ্‌যাপন আছে। ভারতের হোলির পাশাপাশি বাঙালির দোলের এই সুন্দরের পার্বণের শুরু হিসেবে ১৯২৩ সালকে স্মরণ করা যেতে পারে, কারণ— সে বারই প্রথম শান্তিনিকেতনের বসন্তের আসর বসেছিল, ফাল্গুনী পূর্ণিমায় আশ্রম-সম্মিলনীর অধিবেশনে বসন্ত-বন্নার আয়োজন হয়েছিল। এর আগে এমন আসরের কথা আর জানা যায় না, যদিও বসন্তের গান গাইতে গাইতে আশ্রম পরিক্রমার একটি প্রথা এর আগেও ছিল। আর, রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহে ১৯০৭ সালে খেলাচ্ছলে এক ধরনের ঋতু-উৎসব পালন করা হয়েছিল বটে, কিন্তু তা দোলের দিন অনুষ্ঠিত হয়নি, এবং নিয়মিত ভাবেও তা ঘটেনি। বরং নিয়মিত ফাল্গুনী পূর্ণিমায় বসন্তোৎসব পালন উনিশশো বিশের দশকের উত্তরাধিকার।

শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের সম্মিলিত উৎসাহে যে গানে-নাচে-কবিতায় আবিরের রং লাগত, একশো বছর পর কি বাঙালির মধ্যে সেই বসন্তসুন্দর উদ্‌যাপনের মানসিকতা কিছুমাত্র অবশিষ্ট আছে?— গূঢ় প্রশ্ন। তবে উত্তরটি যে সহজ নয়, এটুকুই যা কিছু আশার কথা। বড় করে একটি ‘না’ কিন্তু এখনও বলা যাচ্ছে না, যদিও বসন্তোৎসব কথাটির সঙ্গে বাঙালির দূরত্ব হুহু করে বাড়ছে, যদিও বাংলার তরুণ প্রজন্ম এখন দোল বলতে বুঝছে নেশাযাপন, উন্মত্ততা, এমনকি অশ্লীলতা। ক্রমশই তাদের পঙ্কনিমজ্জনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ্যতর, প্রকটতর। শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব বন্ধ করে দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে এর অভ্রান্ত প্রমাণ। তবু
হয়তো এই ছবিই শেষ ছবি নয়। এখনও যে সমাজমাধ্যমে ইতিউতি উঁকি দিয়ে যায় পাড়ার বেসুরো বৈতালিক, কিংবা একঘেয়ে রবীন্দ্রনৃত্য বা লোকনাচের সহস্র নিদর্শন— যুগপৎ তা অনুকম্পা জাগায়, ভরসা জোগায়। বাস্তবিক এই এক বিচিত্র পরিস্থিতি, যেখানে অনুকম্পার মধ্যেও আশা খুঁজতে হয়। কিন্তু দোল বলতে যদি আজও অনেকের মনে এই আবিরমাখা নাচগানের ছবি ভেসে ওঠে, বসন্তের আবাহনের ধর্ম-অতিক্রমী, সংস্কার-নির্বিকার উৎসবটি যদি আজও কোথাও সাড়া জাগিয়ে যায়, তা হলে বলতে হবে, এখনও কিছু বাকি আছে, বাঙালি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়নি।

Advertisement

মুশকিল হল, সংস্কৃতির একটি দিক যদি হয় উত্তরাধিকারের স্মরণ, অন্য দিকটি হল তা নিয়ে পর্যাপ্ত গৌরববোধ। ‘পর্যাপ্ত’ শব্দটি জরুরি। ততটাই গৌরববোধ দরকার যেখানে হয় মেধা দিয়ে, আর নয় মেধার পরিবর্তে পরিশ্রম করে গৌরবের বিষয়টিকে চর্চা করে যাওয়া দরকার। প্রশ্ন আসলে, ওই চর্চার জায়গায় বাঙালি ফিরবে কেমন করে? কে তাদের রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সঙ্গে পরিচিত করাবে, কে বোঝাবে সংস্কৃতিকে কী ভাবে প্রতি দিনের যাপনের অংশ করে তুলতে হয়, নয়তো তা ক্যারিকেচার বা অপ-প্রদর্শন হয়ে দাঁড়ায়? প্রযুক্তি-বিস্ফোরণের বিশ্বায়ন কি এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার যাপনকে বেশি দিন জায়গা দেবে? সুতরাং আশাবাদী বলবেন, ‘সোনার যুগ বিগত’, ‘সব শেষ হয়ে গেল’ আক্ষেপের জন্য হয়তো কেবলমাত্র বাঙালির লঘুতা ও সঙ্কীর্ণতাকেই দায়ী করা চলে না। হয়তো দেশে দেশে আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা কিছু অবশিষ্ট আছে, আজ সবের সঙ্গেই প্রযুক্তি-যুগ লড়াই চালাচ্ছে। এবং যুদ্ধে জিতছে। বৃহত্তর, প্রবলতর, অবশ্যম্ভাবী পরিপ্রেক্ষিতটির সঙ্গে বাঙালির দোলকে বাঁচানোর উপায় বাঙালিকে ভাবতে হবে। সচেতন উদ্যোগ ও প্রয়াস জারি থাকুক এই লক্ষ্যে।

যৎকিঞ্চিৎ

দুনিয়ার ১৪৯টা দেশের মধ্যে নাগরিকদের সুখের নিরিখে ভারত ১৪০তম। গোটা দক্ষিণ এশিয়া— পাকিস্তান ও বাংলাদেশ-সহ, ভারতের চেয়ে সুখী। ভারতের নীচে আছে আফগানিস্তান, জিম্বাবোয়ে, রুয়ান্ডার মতো দেশ। কোথাও তালিবানের বন্দুকের নলে শাসন, কোথাও প্রবল দারিদ্র, কোথাও মহামারি, কোথাও তুমুল মূল্যস্ফীতি। এখানেই ভারতের শাসকদের কৃতিত্ব। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, রাষ্ট্রবিপ্লব— কিচ্ছুটি ছাড়াও যে নাগরিকদের কত খারাপ রাখা যায়, তাঁরা প্রমাণ করে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement