Education Department

দূত-কথা

রাজ্যের শিক্ষাপরিবেশের দুর্গতি ইতিমধ্যেই সাধিত, সেই ক্ষতি ও ক্ষত গভীরতর, রক্তাক্ততর করা ছাড়া এই কার্যক্রমের অন্যবিধ উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:২৪
A Photograph of Mamata Banerjee, Bratya Basu and CV Anand Bose

শিক্ষামন্ত্রীর দাবি, রাজ্যপালকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকেই রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য করা হোক। ফাইল ছবি।

মধুচন্দ্রিমা থেকে কলহ-কর্কশতায় পৌঁছনোর পথটি সব ক্ষেত্রেই বেশ ছোট। রাজ্যবাসী যখন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হৃদ্যতা দেখছিলেন, তাঁরা ভাবছিলেন এ ক্ষেত্রে পথটি কতখানি, কত দিনের দৈর্ঘ্য পেতে চলেছে। ক্রমশ ‘পথ’ ঠিকই তার আপন গন্তব্যে পৌঁছল, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘দূত’ হিসাবে রাজ্যপাল নিজেকে সুসমারোহে প্রতিষ্ঠা করলেন। গত সাত দশক ধরে ভারতের প্রায় সব— বিশেষত বিরোধীশাসিত— রাজ্যেই রাজ্যপালের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রের দূরনিবদ্ধ নিয়ন্ত্রণটি কায়েম করার প্রথা বলবৎ রয়েছে, যদিও কোনও কোনও শাসনে সে প্রথা কুৎসিত রকমের বেশি বলবৎ। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের গত ন’বছরের শাসনকালে বিরোধী-শাসিত পশ্চিমবঙ্গে অবশ্যই সযত্ন-নির্বাচিত ব্যক্তির উপর এই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, এবং সে দায়িত্ব সুসম্পাদিত হলে সযত্ন-প্রেরিত পুরস্কারও এসেছে অপূর্বদৃষ্ট রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদার উপঢৌকন নিয়ে। পূর্বতনের পদচিহ্ন অনুসরণ করে এই রাজ্যের বর্তমান রাজ্যপালও আপাতত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত, এবং/সুতরাং, এক অনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করে চলেছেন। সাম্প্রতিক কালে একাধিক ঘটনায় তাঁর সেই ভূমিকা স্পষ্ট।

‘মত্তহস্তী’র সঙ্গে তুলনাটি অনভিপ্রেত, কিন্তু মাননীয় রাজ্যপাল যে ভাবে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তার বিসদৃশতা অনুপেক্ষণীয়। শিক্ষামন্ত্রীর দাবি, রাজ্যপালকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকেই রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য করা হোক। বক্তব্য পরিষ্কার: মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য প্রশাসনের পাশ কাটিয়ে রাজ্যপাল ও কেন্দ্রীয় প্রশাসন রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাথা গলাতে পারেন না। দাবিটিতে যুক্তি আছে: শিক্ষা বিষয়টি যৌথ তালিকার অন্তর্গত, রাজ্যের অধিকার অনস্বীকার্য। কিন্তু দাবিটির মুশকিল আবার সেই অধিকারের দড়ি-টানাটানির মধ্যে। যেন সত্যিই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার মধ্যে বিবিধ সরকারি নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণের তুলনামূলক যোগবিয়োগ গুণভাগের বাইরে আর কোনও হিসাব নেই। অথচ, প্রশ্নটি আদতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণেরই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম চলনবলন যদি রাজনীতির স্বার্থে এত সরাসরি নিয়ন্ত্রিত হয়, তাকে আর গণতন্ত্রমতে মুক্তশিক্ষাঙ্গন বলা যায় কি? রাজ্যপাল যা করছেন, তা অতীব দৃষ্টিকটু, এমনকি অনৈতিক। কিন্তু উল্টো দিকে অন্য কোনও শাসকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনারদাবিটিও সমধিক আপত্তিকর। রাজ্যপাল তথা রাজনৈতিক নেতাকর্তাদের বিশ্ববিদ্যালয়-বিহার এখনই পরিত্যাজ্য। রাজ্যের শিক্ষাপরিবেশের অশেষ দুর্গতি ইতিমধ্যেই সাধিত, সেই ক্ষতি ও ক্ষত গভীরতর, রক্তাক্ততর করা ছাড়া এই কার্যক্রমের অন্যবিধ উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।

Advertisement

তবে শেষ পর্যন্ত তো প্রশ্নটি নিছক বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত নয়, আরও বড়। রাজ্যপাল বোস কিছু দিন আগেই আইনশৃঙ্খলার প্রসঙ্গে সংবিধান মেনে চলার আত্যন্তিক গুরুত্বের কথা মনে করিয়েছিলেন। মুশকিল হল, সংবিধান অনুযায়ী চলতে গেলে সর্বাগ্রে রাজ্যপালকেই ভেবে দেখতে হয়, নিজ ব্যবহারবিধির আমূল পরিবর্তন কী ভাবে করা সম্ভব। তাঁর নিয়োগকর্তারা যা-ই বলুন না কেন, সত্যিই যদি কোনও রাজ্যপাল সংবিধানমনস্ক হন, তাঁকেই ভাবতে হবে, সংবিধান যে ভাবে এই পদটির বিবেচনা করেছিল, যে আলঙ্কারিকতার মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল, তিনি বা তাঁরা সেই সাংবিধানিক নীতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকছেন কি না। আজকের রাজ্যপালদের যে ‘দৌত্য’ভূমিকা, ভারতীয় সংবিধান তা স্থির করে দেয়নি, ভারতীয় রাজনীতিই তার এই চেহারা তৈরি করেছে। রাজ্যপালের আনুগত্য দিল্লির কর্তার কাছে, না কি সংবিধানের কাছে, তাঁরাই বিচার করুন। আর, শেষ পর্যন্ত, যদি আত্ম-সংশোধন ও আত্মসংবরণের কাজটি তাঁরা না-ই পারেন, তবে সংবিধানের দোহাই দেওয়ার মুখ আদৌ তাঁদের থাকে কি?

আরও পড়ুন
Advertisement