Swami Vivekananda

দেশব্রতের দৃষ্টান্ত

শিকাগোর ধর্মমহাসভায় ভারতের বৈশিষ্ট্য হিসাবে যে সমন্বয়ী চিন্তাধারার কথা তিনি ঘোষণা করেছিলেন তারই সূত্রে ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে তিনি একাত্মতা বোধ করতেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:২৬
Swami Vivekananda

স্বামী বিবেকানন্দ। —ফাইল চিত্র।

আপাতত এই দেশে স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে টানাটানি চতুর্দিকে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা বিবেকানন্দকে তাঁদের দলের লোক বলে প্রমাণ করার জন্য সদা সচেষ্ট। বিবেকানন্দের মূর্তি প্রয়োজন ও সুযোগমতো প্রতিষ্ঠা করে তাঁরা ঘোষণা করতে ব্যস্ত যে, বিবেকানন্দের গৈরিক বস্ত্রের সঙ্গে তাঁদের গৈরিকীকরণযজ্ঞের গভীর যোগ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষের আবেগকে উস্কে তোলার জন্য বিবেকানন্দের ছদ্ম-মুখোশে মুখ ঢাকতে চাওয়া ও বিবেকানন্দের ছদ্মঢাল সামনে রাখার কার্যক্রম ইদানীং সর্বত্র চোখে পড়ে। বিবেকানন্দের আদর্শের সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্কবিহীন এই রাজনৈতিক কৌশল— নিতান্তই ভোটপন্থী চাতুর্য। বিবেকানন্দের প্রয়াণের পর তাঁর বাণী ইংরেজ সরকারের কাছে মুচলেকা দেওয়া হিন্দুত্ববাদীদের নয়, দেশব্রতী কর্মযোগীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। কেন? দেশের জন্য আত্মত্যাগে বিবেকানন্দ তাঁদেরকে উদ্দীপিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বিবেকানন্দের কর্মযোগ তাঁদের আকর্ষণ করেছিল, বিবেকানন্দের কবিতা সম্বলিত বীরবাণী নামের পুস্তিকাটিও প্রকাশ পেয়েছিল। শুধু বঙ্গদেশেই নয়, ভারতের অন্যত্র বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে তাঁর বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। তাঁর ইংরেজি ও বাংলা ভাষার রচনাগুলি ধ্বনি-ঝঙ্কারময়, বিশ্বাসের প্রত্যয়ে দীপ্ত। ঔপনিবেশিক ভারতে এই আত্মপ্রত্যয় প্রদায়ী বাণীর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বিবেকানন্দের শিষ্যা ভারতপ্রেমী নিবেদিতা তাঁর স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি (দ্য মাস্টার অ্যাজ় আই স হিম) গ্রন্থে বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের যে বিবরণ দিয়েছিলেন তাতে এই প্রত্যয়ের কথাটি আলাদা ভাবে জানিয়েছিলেন।

Advertisement

এই প্রত্যয়কে বিবেকানন্দ ‘আত্মশ্রদ্ধা’ বলে মনে করতেন। কঠোপনিষদ-এর নচিকেতা-আখ্যানের নব-ভাষ্যকার তিনি। নচিকেতার মনে আত্মশ্রদ্ধা জেগে ওঠার ফলে সে নিজেকে কখনও হীন-দীন বলে মনে করেনি। জগৎশ্রেষ্ঠ সে নয়, তাই বলে সে নিজেকে নিকৃষ্টও মনে করে না। তার এই আত্মশ্রদ্ধা আত্মমর্যাদাবোধ সঞ্জাত। আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ধর্মবোধ আর আত্মগর্বী হিন্দুত্ববাদ দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোভাব— দু’টির মধ্যে গুণগত ও মাত্রাগত পার্থক্য আছে। আত্মমর্যাদাবোধ অপরের মর্যাদার হানি ঘটায় না, আত্মগর্ব অপরের মর্যাদার হানি ঘটাতে তৎপর। ধর্মীয় আত্মগর্ব আর রাষ্ট্রীয় আত্মগর্ব দুই-ই অপরকে গ্রাস করতে চায়। অপরকে গিলে খাওয়ার এই চেষ্টা ক্ষমতাতন্ত্রের প্রকৃতি। বিবেকানন্দ অপরের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন— তিনি মূর্খ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসীকে নিজের ভাই বলতে দ্বিধা করেননি। এ কেবল কথার কথা ছিল না— বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুভাইদের সেবাকার্যে এই আত্মীয়তার বোধ প্রকাশিত হয়েছিল। দরিদ্র ভারতবাসীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। তার জন্য প্রয়োজন হলে ধর্মের নামে গচ্ছিত অর্থ ব্যয় করতেও বিবেকানন্দ কুণ্ঠিত ছিলেন না। তাঁর গুরুভাই স্বামী অখণ্ডানন্দ দুর্ভিক্ষের সময় তীব্র ভাষায় ভারতের নানা মঠের প্রধানদের কাছে নিবেদন করেছিলেন, যেন ধর্মীয় আচারের জন্য গচ্ছিত অর্থ জনগণের সেবায় বণ্টন করে দেওয়া হয়।

শিকাগোর ধর্মমহাসভায় ভারতের বৈশিষ্ট্য হিসাবে যে সমন্বয়ী চিন্তাধারার কথা তিনি ঘোষণা করেছিলেন তারই সূত্রে ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে তিনি একাত্মতা বোধ করতেন। অগ্নিবর্ণ ও চণ্ডাশোকের মতো অপশাসক ইসলাম ধর্মাবলম্বী ভারতীয় শাসকদের মধ্যে কেউ থাকতেই পারেন, তাই বলে আকবরের মাহাত্ম্য খর্ব হয়ে যায় না। মোগল ভারতের শাসকবিশেষের সুশাসনের কথা বিবেকানন্দ তাঁর বর্তমান ভারতপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্য রচনায় উল্লেখ করেছিলেন। বিবেকানন্দের প্রয়াণের পর তাঁর চিন্তাধারাকে ধর্মীয় স্বার্থান্বেষীরা যাতে নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে না পারেন, তার জন্য বিশেষ তৎপরতা প্রদর্শন করেছিলেন তাঁর ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। ভূপেন্দ্রনাথ ‘যুগান্তর’ দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ঔপনিবেশিক পুলিশের হাতে কারাবাস করেছিলেন ও পরে বিশিষ্ট বামপন্থী চিন্তক ও কর্মী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর অগ্রজ বিবেকানন্দের রচনার মধ্যে মানবতাবাদী বিপ্লবাত্মক কথাগুলি পাঠকসমাজের কাছে তুলে ধরার জন্য তিনি ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন। বিবেকানন্দ তাঁর ভ্রাতার বিচারে ‘দেবতা’ বা ‘অবতার’ নন। দেশ-কাল-সমাজের কার্য-কারণ সূত্রে গড়ে ওঠা মানবতাবাদী স্বাদেশিক সন্ন্যাসী। তাঁকে উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রচারক হিসাবে মূর্তিবন্দি করার রাজনীতি ভূপেন্দ্রনাথের যুক্তিতে অনায়াসে খণ্ড-বিখণ্ড করা যায়।

আরও পড়ুন
Advertisement