Panchayat

‘তুমি কোন দলে?’

পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার বলেছেন, তথ্য রাখার স্বার্থেই পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধিদের দলীয় পরিচিতির তালিকা করতে বলা হয়েছে প্রশাসনিক আধিকারিকদের।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৩ ০৫:২৮
Representational image of TMC.

সদস্যদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রশাসনের কাজে কখনওই বিবেচ্য হতে পারে না। প্রতীকী ছবি।

সরকারি কাজ আর রাজনৈতিক দলের কাজের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, সে সত্যটা তৃণমূল সরকার হয় একেবারেই ভুলেছে, না হলে জেনেবুঝে নস্যাৎ করতে চাইছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতের সদস্যরা কে কোন রাজনৈতিক দলে রয়েছেন, তার তালিকা তৈরি করতে রাজ্য সরকার নির্দেশ দিয়েছে জেলা পঞ্চায়েত আধিকারিকদের। এতে একই সঙ্গে কৌতুক, বিরক্তি, এবং আশঙ্কা জাগে। হাসির উদ্রেক হয় তৃণমূলের দলীয় রাজনীতির দুর্দশায়। পঞ্চায়েতব্যবস্থায় যুক্ত প্রায় পঁয়ষট্টি হাজার জনপ্রতিনিধির কত জন তৃণমূলের, কত জন ঘোষিত বা অঘোষিত ভাবে ‘দলবদলু’, তার হিসাব কি তা হলে দলের কাছেই নেই? জেলা এবং ব্লক স্তরের দলীয় সংগঠন হয় সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে না, নয়তো তাদের তথ্যের উপরে আস্থা রাখতে পারছেন না শীর্ষ নেতারা। দ্বিতীয়টিই সত্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কারণ অভিজ্ঞতা বলে যে, প্রতিটি নির্বাচনের আগেই তৃণমূলের নগ্ন ও হিংস্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ পায়, এক বছর আগে যার ভয়াল রূপ রাজ্য দেখেছিল বীরভূমের বগটুইয়ে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিরোধীর সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘাতের চেয়ে তৃণমূলের অভ্যন্তরে অবৈধ কারবারের বখরা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম প্রবল নয়, তাতে বার বার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে দলের শক্তির পরিমাপ করতে গিয়ে শীর্ষ নেতারা যে জেলার নেতাদের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না, তা আশ্চর্য নয়। পুলিশের উপর তৃণমূল নেতা-নেত্রীদের ভরসা সুবিদিত— জেলাস্তরে বিবিধ কার্যকলাপের সমন্বয়ে পুলিশের ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ, তা নানা পাচারের তদন্তে, এবং নির্বাচনী অপরাধের সংবাদে বার বার সামনে এসেছে। তবে পুলিশের সঙ্গে দলীয় নেতৃত্বের বোঝাপড়া ছিল অলিখিত। এখন যে তাতেও কাজ চলছে না, দলের হাল বুঝতে পঞ্চায়েতব্যবস্থার আধিকারিকদের লিখিত নির্দেশ দিতে হচ্ছে, তাতে নির্বাচনী ‘খেলা’-র গ্যালারিতে বসা দর্শকের মুখে বাঁকা হাসির রেখা ফুটতে বাধ্য। সেই সঙ্গে ফুটছে কপালে বিরক্তির ভাঁজ— রাজ্য সরকারের কাণ্ডজ্ঞানের অভাবে। দলীয় রাজনীতির দৃষ্টি স্বার্থের দ্বারা খণ্ডিত হতে পারে— তার ঝোঁক বরাবরই সব সীমা লঙ্ঘন করে ক্ষমতা পাওয়ার এবং রক্ষা করার দিকে। কিন্তু নির্বাচিত সরকারের কাছে দেশের প্রধান প্রত্যাশা ঔচিত্যের সীমার বোধ। পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার বলেছেন, তথ্য রাখার স্বার্থেই পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধিদের দলীয় পরিচিতির তালিকা করতে বলা হয়েছে প্রশাসনিক আধিকারিকদের। কিন্তু পঞ্চায়েত ব্যবস্থার কাছে, অথবা রাজ্য সরকারের কাছে জনপ্রতিনিধির রাজনৈতিক পরিচয় কবে ‘প্রয়োজনীয় তথ্য’ হয়ে উঠল, আর কেনই বা, মন্ত্রিমহাশয় স্বাভাবিক ভাবেই সে কথা জানাননি।

Advertisement

বরং উল্টোটাই সত্য হওয়ার কথা— সদস্যদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রশাসনের কাজে কখনওই বিবেচ্য হতে পারে না। দলীয় পরিচয়ে পঞ্চায়েত সদস্য নির্বাচিত হলেও, আসনে বসার পরে তাঁর একটাই পরিচয়: তিনি তাঁর এলাকার প্রতিটি মানুষের প্রতিনিধি। এ কথা সাংসদ, বিধায়কদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, কিন্তু গ্রামের উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়ের বিবিধ কাজের খুঁটিনাটি যে-হেতু পঞ্চায়েত সদস্যের উপর নির্ভরশীল, তাই তাঁর সর্বজনগ্রাহ্যতা আরও বেশি জরুরি। গ্রাম পঞ্চায়েতের পরিকল্পনার জন্যও দল-নির্বিশেষে ঐকমত্য দরকার। সর্বোপরি, পঞ্চায়েতব্যবস্থার আদর্শগত ভিত্তি হল প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র। তাই নির্বাচিত প্রার্থী বা নির্বাচক, যে কাউকে কোনও একটি দলের বলে চিহ্নিত করতে চাইলে আদর্শের বিরোধিতা করা হয়। এই মৌলিক সত্যটি যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে তৃণমূল সরকারকে মনে করাতে হচ্ছে, এটাই উদ্বেগের বিষয়। গণতন্ত্রের শাঁসহীন খোলা নিয়ে খেলার নামই কি তবে নির্বাচন?

আরও পড়ুন
Advertisement