Ram Temple

মন্দিরাস্ত্র

প্রায় চার দশক ব্যাপী মন্দির-রাজনীতির চূড়ান্ত পর্বে আয়োজিত অযোধ্যার এই কর্মকাণ্ড একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বিশেষ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৩২
রামমন্দির তৈরির শেষ পর্বের কর্মব্যস্ততা।

রামমন্দির তৈরির শেষ পর্বের কর্মব্যস্ততা। —ফাইল চিত্র।

সমাজমাধ্যমে ভারতীয় জনতা পার্টির নিজস্ব পরিসরটিতে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে নতুন অলঙ্করণ। তার গৈরিক চালচিত্রের অর্ধেকের বেশি জমিতে প্রসারিত অযোধ্যার রামমন্দির, মন্দিরের সামনে নরেন্দ্র মোদী, তাঁর মুখমণ্ডল মন্দিরশীর্ষ থেকে ঈষৎ নীচে, অন্য দিকে দলের সভাপতি জে পি নড্ডার মুখ, উচ্চতায় প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা কিঞ্চিৎ খাটো। মাঝখানে, লাল প্রেক্ষাপটে গেরুয়া অক্ষরে চকচকে ‘জয় শ্রীরাম’-এর নীচে লেখা: ২২ জনওয়রী ২০২৪। এ-চিত্র দেখিয়ে যক্ষ যদি প্রশ্ন করেন ‘কা-চ বার্তা’, যুধিষ্ঠিরের অনুজরাও অনায়াসে ঠিক উত্তর বলে দেবেন। বার্তাটি নির্বাচনী অভিযানের। ২২ জানুয়ারি অযোধ্যার মন্দিরে বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রামলালা ‘বিরাজমান’ হবেন— এই অনুষ্ঠানের পোশাক ধর্মীয়, কিন্তু তার অন্তরাত্মায় যে লক্ষ্যটি বিরাজ করছে, তার নাম ভোট। দিনক্ষণ নির্ধারণে পঞ্জিকার ভূমিকা অবশ্যই আছে, কিন্তু তা নিতান্তই খুঁটিনাটির ব্যাপার, নির্বাচনী নির্ঘণ্টের অঙ্ক কষেই এই মন্দিরের নির্মাণ থেকে শুরু করে উদ্বোধন অবধি সমগ্র কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। লোকসভার ভোটযুদ্ধে অযোধ্যার রামমন্দির স্পষ্টতই ভারতীয় জনতা পার্টি এবং তার সর্বাধিনায়কের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।

Advertisement

প্রায় চার দশক ব্যাপী মন্দির-রাজনীতির চূড়ান্ত পর্বে আয়োজিত অযোধ্যার এই কর্মকাণ্ড একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বিশেষ। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অযোধ্যায় সাতাশ বছর আগে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের জমিতে রামমন্দির নির্মাণের পথ পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২০২৪-কে নিশানা করে রাজসূয় যজ্ঞ শুরু হয়ে গিয়েছিল। আগামী মাসে সেই যজ্ঞের পূর্ণাহুতি। নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর অনুগামীরা সেই হোমের তিলক কপালে এঁকে ঘোষণা করবেন: বলেছিলাম ‘ওইখানেই’ রামমন্দির বানাব, বানিয়ে দিলাম— এ বার আমাদের জয়ী করুন, বার বার তিন বার। লক্ষণীয়, সাম্প্রতিক রাজ্য বিধানসভা ভোটের প্রচারে মন্দিরাস্ত্রটিকে পূর্ণোদ্যমে ব্যবহার করেছেন শাসক দলের প্রচারকরা। সেই সময় থেকেই ২২ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে জনচিত্ত আকর্ষণের রকমারি আয়োজন চলছে। দেশ জুড়ে রাম-বন্দনা, হনুমান চালিসা পাঠ, ধর্মীয় সমাবেশ ইত্যাদি তো আছেই, রাজ্যে রাজ্যে দল এবং দলীয় সরকার থেকে নাগরিকদের অযোধ্যায় রামমন্দির দর্শনের ব্যবস্থা এবং বিপুল ভিড় সামলানোর এবং অতিথিদের থাকা-খাওয়ার এলাহি বন্দোবস্তও করা হচ্ছে, এবং হবে। কেন্দ্র-রাজ্য ‘ডাবল ইঞ্জিন’-এর টানে রাষ্ট্রযন্ত্র কেবল চলছে না, রীতিমতো দৌড়চ্ছে।

যথার্থ এবং সর্বজনীন উন্নয়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র কেন এমন সঙ্কল্প সামনে রেখে এবং অনুরূপ উদ্যম সহকারে সচল হয় না, দারিদ্র বুভুক্ষা অপুষ্টি অশিক্ষা অস্বাস্থ্যের অচলায়তন ধূলিসাৎ করে অগণন নাগরিকের সুস্থ জীবনসৌধ গড়ে তুলতে কেন শাসকরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন না, সেই সব প্রশ্ন তুলে কিছুমাত্র লাভ নেই। তাঁদের লক্ষ্য হিন্দু ভোট সংহত করে নিজেদের ঝুলিতে নিয়ে আসা। মন্দির নির্মাণের মোহময় আকর্ষণকে সেই উদ্দেশ্য সাধনে কব্জি ডুবিয়ে ব্যবহার করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। এই কৌশলটি যদি সফল হয়, তা হলে একযোগে দু’টি সমস্যা এড়ানো যাবে। এক, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ইত্যাদিতে বিপুল ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি করতে হবে না, কারণ এই সব বিষয়ে মানুষের সব প্রশ্ন ভক্তিরসের প্লাবনে ভেসে যাবে— ভক্তি রামের প্রতি, ততোধিক মোদীর প্রতি। দুই, জাতপাতের সংঘাত, দলিত নাগরিকের নিরন্তর নিপীড়ন, জনজাতি মানুষের ধারাবাহিক বঞ্চনা— সমস্ত ধরনের বিভাজন-রেখাগুলিকে আড়াল করে ‘অখণ্ড হিন্দুত্ব’ নামক বিজেপি তথা সঙ্ঘের ছাতার নীচে জড়ো করতে পারলে সংখ্যাগুরুতন্ত্রের ইমারতটি জোরদার হবে। নরেন্দ্র মোদীরা সর্বশক্তি দিয়ে এই চেষ্টা করছেন ও করবেন। রামমন্দির তার প্রতীক এবং উপকরণ।

আরও পড়ুন
Advertisement