TMC and BJP

ধ্বংসের রাজনীতি

বিরোধী রাজনীতির অনুশীলনে উত্তাপের ভূমিকা অবিসংবাদিত। শাসকের দুর্বলতা সন্ধান করে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলন নির্মাণ করা বিরোধীদের বড় কাজ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৫৪

—প্রতীকী ছবি।

কার্যকারণসূত্র দৃশ্যত সুস্পষ্ট। গত বুধবার, ২৯ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কলকাতার সভা শেষ করে শহর ছাড়ার পরেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের নেতারা বিধানসভা চত্বরে হাজির হন এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ধর্নার পাল্টা ধর্নায় বসে পড়েন, দুই পক্ষের স্লোগান ও স্লোগান-অতিরিক্ত সুভাষিতাবলির সওয়াল-জবাব দ্রুত প্রবল থেকে প্রবলতর আকার ধারণ করে। রাজ্যের শাসক দলের অভিযোগ, কেন্দ্রের অন্যায়ের প্রতিবাদে তাঁদের ধর্নার কর্মসূচি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল, রাজ্য বিজেপির প্রতিবাদ বিক্ষোভের তেমন কোনও পূর্ব ঘোষণা ছিল না, তাঁদের ‘পাল্টা’ অভিযান অনৈতিক এবং দুরভিসন্ধিপ্রসূত। অনুমান করা সহজ যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভায় তৈরি হওয়া উত্তাপটুকু কাজে লাগানোর তাগিদেই দলের রাজ্য নেতারা বিধানসভার চত্বরে ‘সম্মুখসমর’-এ অবতীর্ণ হন। অতঃপর উত্তাপ ক্রমশ বেড়েছে, তিন রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণার পরে আরও বাড়বে।

Advertisement

বিরোধী রাজনীতির অনুশীলনে উত্তাপের ভূমিকা অবিসংবাদিত। শাসকের দুর্বলতা সন্ধান করে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলন নির্মাণ করা বিরোধীদের বড় কাজ। কিন্তু অধুনা সেই কাজটি প্রায় সম্পূর্ণত একমাত্রিক একটি আচারে পর্যবসিত হয়েছে— ক্রমাগত শাসকের বিরুদ্ধে তোপ দেগে চলা এবং পরবর্তী নির্বাচনে তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার আহ্বান জানানোর মধ্যেই বিরোধী প্রচারকরা নিজেদের সমস্ত প্রচারকে কেন্দ্রীভূত রাখেন। এই বিষয়ে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে যে কোনও প্রচারের মঞ্চে বা ময়দানে, বিজেপির নেতানেত্রীরা কার্যত তুলনারহিত। তাঁদের আহ্বানে ও আস্ফালনে গঠনমূলক কথা অত্যন্ত বিরল, সমস্ত উত্তাপ কেবল বিধ্বংসী আস্ফালন থেকেই উৎসারিত হয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয় বিদ্বেষ ও বিভাজনের মন্ত্রপাঠ। অমিত শাহের সাম্প্রতিক ভাষণেও সেই একই ঐতিহ্য অনুসৃত হয়েছে। তিনি বাঁধা গতের অঙ্গভঙ্গি সহকারে পরিচিত হুঙ্কার দিয়েছেন, সংখ্যাগুরু ভোট আকর্ষণের লক্ষ্যে সিএএ প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন, কিন্তু কোনও সুষ্ঠু কার্যক্রমের আভাস তাঁর কথায় মেলেনি, এমনকি তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতির সমালোচনাতেও বস্তাপচা কিছু চিৎকার ছাড়া আর কিছুই শোনাতে পারেননি। শোরগোলের রাজনীতিতে ইন্ধন জোগানোই তাঁর লক্ষ্য ছিল, সেই লক্ষ্য পূরণ করে স্বস্থানে প্রস্থান করেছেন। দলের লোকেরাও নতুন উদ্যমে শোরগোল তুলতে বিধানসভার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।

শাসক দলের সদস্যরাও শোরগোলের রাজনীতিতেই পরম আগ্রহী। অতএব বিধানসভা ভবন দুই তরফের দ্বৈরথের রণভূমিতে পরিণত হয়েছে। সংসদীয় রাজনীতির প্রধান প্রতিষ্ঠানটিকে সামনে রেখে অশোভন আচরণের যে কদর্য প্রতিযোগিতা দেখা গিয়েছে, তা দুই শিবিরের পক্ষেই চরম অমর্যাদার এবং রাজ্যের পক্ষে চরম লজ্জার। ‘চোর’ বনাম ‘পকেটমার’ গোত্রের গালি বিনিময় থেকে শুরু করে এক পক্ষের উপস্থিতিতে ‘অপবিত্র’ ভূমিতে অন্য পক্ষের গঙ্গাজল ছড়িয়ে ‘শোধন’ করার উৎকট উদ্যোগ, বিরোধী দলনেতাকে বিধানসভায় সাসপেন্ড করা, তার প্রতিবাদে বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রীকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত— এই নিম্নস্তরের কলহ রাজ্য রাজনীতিকে আরও বেশি অসুস্থ করে তুলছে, গণতান্ত্রিক পরিবেশকে উত্তরোত্তর দূষিত করছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মৌলিক ক্ষতি হচ্ছে। যেমন, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রধান নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলনেতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে এই উদ্দেশ্যে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি সেই আমন্ত্রণ সপাটে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কারণ বৈঠকে গেলে আর মুখ্যমন্ত্রীকে বয়কট করা হয় কী করে? অর্থাৎ, দলীয় সংঘাতই আসল, গণতান্ত্রিক রীতি ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ গৌণ। শাসক এবং বিরোধী, দুই পক্ষই নেতিবাচক এবং বিধ্বংসী রাজনীতির একনিষ্ঠ সেবক হলে যা ঘটবার, পশ্চিমবঙ্গে তা-ই ঘটছে।

আরও পড়ুন
Advertisement