Narendra Modi

রাজধর্ম কাকে বলে

কিছু কাল ধরেই স্পষ্ট, ভারতে গণতন্ত্রের আব্রু রক্ষার, নাগরিকের অধিকার বজায় রাখার দায়িত্বটি ন্যস্ত রয়েছে কেবলমাত্র আদালতের উপরে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৫৯
narendra modi.

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

পশ্চিমবঙ্গ, ছত্তীসগঢ় বা রাজস্থানে কী ঘটেছে, সেই উদাহরণ টেনে মণিপুরের ‘অভূতপূর্ব হিংসা’-কে মুহূর্তের জন্যও মার্জনা করা চলে না। কথাগুলি বললেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। ভারতীয় গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্য, এই কথাটিও সেই আদালতকেই বলে দিতে হল। ‘দেশের সব মেয়ের সুরক্ষা’ চেয়ে মণিপুরের সঙ্গে অন্য রাজ্যগুলির পরিস্থিতির বিবেচনা করার দাবিটি কোনও এক বাদীর তরফে কোনও এক আইনজীবী পেশ করেছিলেন বটে, কিন্তু অন্য রাজ্যে কী ঘটছে, মণিপুরের প্রসঙ্গে সেই ‘হোয়াটঅ্যাবাউটারি’র সূত্রপাত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে। গত ন’বছরে ভারতবাসী জেনেছে যে, ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারার যে সাধনা, প্রধানমন্ত্রী মোদীর তাতে আগ্রহ নেই। ফলে, বিজেপি-শাসিত মণিপুরের ঘটনার প্রতিযুক্তি হিসাবে তিনি টেনেছেন ঠিক সেই রাজ্যগুলির কথাই, যেখানে বিরোধী শিবিরভুক্ত দল ক্ষমতায়। অন্য কোনও পরিপ্রেক্ষিতে এই রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতা ভারতবাসীকে অবাক করত না। কিন্তু, ৪ মে তারিখে মণিপুরে যা ঘটেছে, সেই বীভৎসতার ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসার পরও যে প্রধানমন্ত্রী সেই ক্ষুদ্রতার আরাধনাতেই আটকে থাকলেন, তা দেখে বিস্মিত হতে হয়। রাজধর্ম পালনে যে তিনি অভ্যস্ত নন, মণিপুরের ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়া তা আবার প্রমাণিত হল। বুঝিয়ে দিল, ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের যদি বিন্দুমাত্র প্রত্যাশাও থাকে, তবে সেই প্রত্যাশা কেবলমাত্র বিচারবিভাগের প্রতিই। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় যা বলেছেন, প্রকৃত প্রস্তাবে তা সরকারকে রাজধর্ম পালনের কথা মনে করিয়ে দেয়। দুর্ভাগ্য যে, আদালত বাধ্য না করা অবধি দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারীরও সেই কর্তব্যের কথা মনে পড়ে না।

Advertisement

কিছু কাল ধরেই স্পষ্ট, ভারতে গণতন্ত্রের আব্রু রক্ষার, নাগরিকের অধিকার বজায় রাখার দায়িত্বটি ন্যস্ত রয়েছে কেবলমাত্র আদালতের উপরে। আদালত বাধ্য করলে তবেই সরকার সেই কাজগুলি করে, যেগুলি করা তার স্বধর্ম হিসাবে বিবেচিত হওয়ার কথা। গণতন্ত্রের পক্ষে এ এক বিরাট দুঃসংবাদ— আইনবিভাগ এবং শাসনবিভাগের কাজও বিচারবিভাগকে করতে হলে, বা প্রতি পদক্ষেপে বিচারবিভাগকে তাদের দায় ও দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হলে গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলির আপেক্ষিক গুরুত্বের ভারসাম্য থাকে না। দুর্ভাগ্য যে, দেশের সর্বোচ্চ নেতাদেরও আর চক্ষুলজ্জার বালাই নেই। দেশ জুড়ে প্রতিবাদ হলেও তাঁরা পরোয়া করেন না, বিরোধীরা কোনও প্রকট অন্যায়ের দিকে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তাঁরা চোখ বুজে থাকেন। তাঁদের কাছে দলীয় স্বার্থই চূড়ান্ত। ফলে, যে কাজ তাঁদের স্বাভাবিক দায়িত্ব হিসাবে গণ্য হওয়ার কথা, সেই দায়িত্ব সম্পাদন করতেও আদালতকে তাঁদের বাধ্য করতে হয়। এই ভারতে ‘রাজধর্ম’ কথাটি তার অর্থ হারিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রবণতার এক চরম উদাহরণ। কিন্তু তিনিই একমাত্র নন। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদেরও কি বারে বারেই স্মরণ করিয়ে দিতে হয় না যে, কোন কাজটি তাঁদের কর্তব্য, আর কোন কাজটি কোনও অবস্থাতেই করা চলে না? এ কথা কি আশ্চর্যের নয়, আদালতকে রাজ্যের শাসক দলের সর্বোচ্চ নেতাদের বলে দিতে হচ্ছে যে, বিরোধী দলের নেতাদের বাড়ি ঘেরাও করার ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’টি চলতে পারে না? যত ক্ষণ না আদালত বাধা দিচ্ছে, তত ক্ষণ অবধি দায়িত্বজ্ঞানহীনতাই মোক্ষ, গোটা দেশের রাজনীতি এমন অতলে তলিয়ে গেল কী ভাবে, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করলে একটি কথাতেই পৌঁছনো সম্ভব। যাঁরা রাজনীতির ব্যাপারি, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁদের বিন্দুমাত্র সম্ভ্রম নেই। ফলে, কোনটি কর্তব্য আর কোনটি নয়, সেই বিবেচনার কোনও নৈতিক কম্পাস আর তাঁদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। ক্ষুদ্রতার সাধনাই আজ ভারতীয় রাজনীতির বাস্তব।

আরও পড়ুন
Advertisement