Jairam Ramesh

দুস্তর অসাম্য

ভারতে আর্থিক অসাম্য বৃদ্ধির ঘটনাকে বারে বারেই জুড়ে দেওয়া হয় অতিমারির বিভীষিকার সঙ্গে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কোভিড-১৯’এর কারণে অসাম্য প্রকটতর হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৪৯
Jairam Ramesh.

জয়রাম রমেশ। —ফাইল চিত্র।

গত দশ বছরে ভারতে মুষ্টিমেয় অতিধনী আরও সম্পদশালী হয়েছেন, আর সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের আর্থিক ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে— আয়করের পরিসংখ্যান তুলে ধরে এ-হেন অভিযোগ করল কংগ্রেস। দলের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ বলেছেন, এই সময়কালে দেশের আয়করদাতাদের তালিকায় শীর্ষে থাকা এক শতাংশ মানুষের আয় সবচেয়ে কম আয়কর দেওয়া পঁচিশ শতাংশ মানুষের আয়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ দ্রুত বেড়েছে। ভারতে আর্থিক অসাম্য যে ক্রমবর্ধমান, সে কথা বলার জন্য আয়করের পরিসংখ্যান ব্যবহার না করলেও চলত; কিন্তু এই তথ্যের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে, যা ভারতের আর্থিক অসাম্যের মাত্রাকে বুঝতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করবে। দেশের একশো বিয়াল্লিশ কোটি মানুষের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন কত জন? আয়কর দফতর জানিয়েছে, এ বছর রেকর্ডসংখ্যক রিটার্ন দাখিল করা হয়েছে— ছ’কোটি সাতাত্তর লক্ষ। এই জনসংখ্যাটিকেই দেশে আর্থিক ভাবে সচ্ছলতম অংশ হিসাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সেই অনুমান নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠবে: যেমন, কৃষি আয় যে-হেতু আয়করযোগ্য নয়, ফলে সেই ক্ষেত্রে থাকা ধনীরা এই হিসাবে নেই; বহু লোকের হাতে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা রয়েছে ইত্যাদি— কিন্তু একশো বিয়াল্লিশ কোটির অনুপাতে সেই আপত্তিগুলি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ নয়। ফলে, আয়করের পরিসংখ্যানকে দেশের সংগঠিত ক্ষেত্রে সচ্ছলতম নাগরিকদের ছবি বলে ধরে নেওয়া যায়। সেখানেও আর্থিক অসাম্যের যে ছবিটি ফুটে উঠছে, তাতে বোঝা যায় যে, আর্থিক সিঁড়ির নীচের ধাপগুলিতে পরিস্থিতি আরও কত ভয়াবহ।

Advertisement

ভারতে আর্থিক অসাম্য বৃদ্ধির ঘটনাকে বারে বারেই জুড়ে দেওয়া হয় অতিমারির বিভীষিকার সঙ্গে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কোভিড-১৯’এর কারণে অসাম্য প্রকটতর হয়েছে। কিন্তু, আর্থিক অসাম্যের মূলগত কারণটি সেই অতিমারিতে নিহিত নয়। তার পিছনে মুখ্য ভূমিকা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক নীতির। তার একাংশ নিছক হঠকারিতা— নোট বাতিল এবং অপরিকল্পিত ভাবে জিএসটি চালু করা, এই দু’টি ঘটনা ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে যে ধাক্কা দিয়েছিল, তার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হয়েছে। অন্য দিকে রয়েছে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষের কথা বিস্মৃত হওয়ার প্রবণতা। তার একটি মোক্ষম উদাহরণ কোভিড চলাকালীন ঘোষিত কেন্দ্রীয় সরকারের চার দফা আর্থিক প্যাকেজ। যেখানে সাধারণ মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ ত্রাণের প্রয়োজন ছিল, অর্থমন্ত্রী সেখানে সুদের সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। তা ছাড়াও, এই সরকারের প্রতিটি বাজেটেরই অভিমুখ প্রত্যক্ষ বণ্টনের বিপ্রতীপ থেকেছে। আর্থিক অসাম্যের ক্ষেত্রে সরকারের সেই নীতিরই প্রতিফলন ঘটেছে।

কোনও অর্থব্যবস্থাকে যে আবশ্যিক ভাবেই প্রত্যক্ষ বণ্টনপন্থী হতে হবে, তেমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। বস্তুত, স্বাভাবিক অবস্থায় বাজারই বণ্টনের শ্রেষ্ঠ পন্থা নির্ধারণ করে। ফলে, কেন্দ্রীয় সরকার যদি নীতিগত ভাবে বাজারপন্থী হয়, তাতে আপত্তির কারণ নেই। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই সরকার যাকে পোষণ করেছে, তার নাম সাঙাততন্ত্র। দু’টি, বা আরও স্পষ্ট ভাবে একটি বাণিজ্যিক গোষ্ঠী, ক্রমে দেশে বাজারের সমার্থক হয়ে উঠেছে। তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাজারপ্রক্রিয়া। বাজারের কুশলতা নিশ্চিত করার আবশ্যিক শর্ত হল প্রতিযোগিতা। সেই ধর্মটিই যদি খণ্ডিত হয়, তবে বাজারের সম্পদ বণ্টনের ক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতে সেই ঘটনাটিই ঘটছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের কথা ভাবতে অক্ষম। আর্থিক অসাম্য যে দেশের ক্রয়ক্ষমতার বিপুল ক্ষতি করছে, এবং তার ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারটিকে নষ্ট করছে, এই কথাটি তাঁরা বুঝতে নারাজ। কেন্দ্রীয় নেতারা পরিসংখ্যানকে অস্বীকার করতে পারেন, অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যভঙ্গের বাস্তবকে তাঁরা চোখ ঠারবেন কী ভাবে?

আরও পড়ুন
Advertisement