Violence

চির রক্তধারা

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, নিচুতলার কর্মীরাই এই ঘটনা ঘটাচ্ছেন, তাঁদের নিয়ন্ত্রণের দায়ও শীর্ষ নেতৃত্বেরই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২২ ০৮:১০

হি‌ংসাই যে পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞান, সে কথা আর নতুন করে প্রমাণ করার নেই। কিন্তু, রামপুরহাটের ঘটনাক্রম এই রাজ্যের মাপেও অস্বাভাবিক, ভয়ঙ্কর। একটি খুন, এবং তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অন্তত আট জন মানুষের আগুনে পুড়ে মৃত্যু— অতি হিংসাশ্রয়ী হিন্দি সিনেমার চিত্রনাট্যেও যে কথা লিখতে চিত্রনাট্যকার দু’বার ভাবতেন, বীরভূমের গ্রামে তা অবলীলায় ঘটে গেল। এই মর্মান্তিক ঘটনার দায় রাজ্যের শাসকরা অস্বীকার করতে পারেন না। দলের এক শীর্ষনেতা বলে দিয়েছেন, এই হত্যাকাণ্ড ‘রাজ্যের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে ষড়যন্ত্র’। আবার, রাজ্য পুলিশের শীর্ষকর্তা তদন্তের আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক যোগ নেই। নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে বিবাদের ফলেই এই ঘটনা, এমন একটি তত্ত্বও হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যপাল আরও এক দফা বাগ্‌যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রাজ্যে যদি একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে থাকে, তবে সেই পরিস্থিতিকে ‘অরাজক’ বলাই বিধেয়। তেমন অভিযোগ উঠলে তা ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ কি না, সেই বিচারে ব্যস্ত না হয়ে সর্বশক্তিতে অরাজকতা দূর করাই প্রশাসনের কর্তব্য। পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, স্থানীয় মাতব্বর থেকে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত কেউই সঙ্কীর্ণ রাজনীতির বাইরে পা ফেলতে নারাজ। ‘নিরপেক্ষ তদন্ত হবে’, এই আশ্বাসটির অন্তঃসারশূন্যতা যদি অগ্রাহ্যও করা যায়, তবুও শুধু তদন্তেই পরিস্থিতি পাল্টাবে না। সবার আগে এই ভয়ঙ্কর ঘটনার দায় স্বীকার করতে হবে।

সেই দায় বহুমাত্রিক। কেন স্থানীয় স্তরে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য হিংসাত্মক ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে, সেই কারণটি এখন সর্বজনবিদিত— এই ক্ষমতা হাতে থাকলে বৈধ ও অবৈধ, সব রকম টাকার জোগানের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। পরিস্থিতিটি এক দিনে এখানে পৌঁছয়নি। শীর্ষ নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রশ্রয় ব্যতিরেকে নিচুতলার কর্মীরা এমন অবাধ তোলাবাজি ও দুর্নীতি চালিয়ে যেতে পারেন কি? দ্বিতীয়ত, শাসক দলের বাহুবলীরা অভিজ্ঞতায় শিখে নিয়েছেন যে, তাঁরা যে অন্যায়ই করুন, দলের ছত্রছায়াটি অক্ষুণ্ণ থাকলে তাঁদের কোনও বিপদ নেই। বীরভূমই উদাহরণ, যেখানে শাসক দলের স্থানীয় নেতা টেলিভিশন ক্যামেরার সামনেই হাস্যমুখে বিরোধীদের অনতিপ্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে থাকেন। প্রশ্রয় বিনা এই দুঃসাহস হয় কি? তৃতীয় দায় পুলিশি অপদার্থতার। এলাকার প্রভাবশালী নেতা খুন হলে তাঁর প্রতিপক্ষের উপর হামলা হতে পারে, এটা পুলিশ নাকি বুঝতেই পারেনি! পশ্চিমবঙ্গে এখন এমনটাই দস্তুর। এই ঘটনাতেও তদন্তের প্রথম ধাপেই স্থানীয় থানার আইসি এবং মহকুমার এসডিপিও-কে সরিয়ে দিতে হল। পুলিশবাহিনীর এই ভয়ঙ্কর হাল কেন, তার দায় শাসকরা অস্বীকার করবেন কী ভাবে?

Advertisement

দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর। সংবাদমাধ্যম, কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্যপাল, বিরোধী রাজনৈতিক দল, কারও ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নয়, তাঁকে প্রথমে স্বীকার করতে হবে যে, রামপুরহাটে যা হয়েছে, রাজ্য জুড়ে যা হচ্ছে, তা প্রশাসনের চূড়ান্ত ব্যর্থতা। তা শাসক দলের রাজনৈতিক ব্যর্থতাও বটে— তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, নিচুতলার কর্মীরাই এই ঘটনা ঘটাচ্ছেন, তাঁদের নিয়ন্ত্রণের দায়ও শীর্ষ নেতৃত্বেরই। রাজনৈতিক হিংস্রতার প্রশ্নে এখন পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশে কার্যত তুলনাহীন। ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে এই মর্মান্তিক সত্যটিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যা কর্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর প্রশাসন তা করলে আজ পরিস্থিতি এখানে পৌঁছত কি? বিরোধী নেত্রী হিসাবে তিনি দীর্ঘ দিন যা বলে এসেছেন, সেই সব কথা মনে করলেই মুখ্যমন্ত্রী বুঝবেন, আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁর এখনকার উক্তিগুলো কেন করুণ পরিহাসের মতো শোনাচ্ছে।

আরও পড়ুন
Advertisement