এই দফায় আর সিভিক ভলান্টিয়ার বা কনস্টেবল নয়, অভিযোগের আঙুল সরাসরি থানার আইসি-র দিকে। ঝালদায় নিহত কংগ্রেসি পুরপ্রতিনিধি তপন কান্দুর স্ত্রী যে অভিযোগ দায়ের করেছেন, তাতে ঝালদা থানার আইসি সঞ্জীব ঘোষের নাম রয়েছে। অভিযোগটির আদৌ কোনও ভিত্তি আছে কি না, অথবা নিহত তপন কান্দুকে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিতে তিনি সত্যই জবরদস্তি করেছিলেন কি না, তদন্ত না হওয়া অবধি এই প্রশ্নগুলির সদুত্তর মিলবে না। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ— সম্ভবত পুলিশের উপরেও— ফলে, বিশ্বাস করতে হবে যে, আইসি-র বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ক্ষেত্রে পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্তই করবে। কিন্তু, অভিযোগ প্রমাণ-অপ্রমাণের তুলনায় অনেক বড় একটি প্রশ্ন এই মুহূর্তে উত্থাপন করা প্রয়োজন— এ কোন রাজ্য, যেখানে এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে পুলিশের বিরুদ্ধে দুই বার খুনের অভিযোগ ওঠে? আনিস খানের মৃত্যুতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছিল, তার নিষ্পত্তি হওয়ার পূর্বেই ঝালদা কাণ্ডে ফের একই অভিযোগ উঠল। আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, সমস্যাটি কোনও ব্যক্তিবিশেষের, বা কোনও নির্দিষ্ট এলাকার নয়— এই সমস্যা প্রকৃত অর্থেই কাঠামোগত। আগুন না লাগলে এত ঘন ঘন ধোঁয়া চোখে পড়ার কারণ নেই, এই কথাটি নেহাত অনভিজ্ঞ জনও মানবেন। ফলে, সমস্যাটি কোথায়, সেই খোঁজ করা প্রয়োজন।
পুলিশ যে তার এক্তিয়ারের গণ্ডি অতিক্রম করেই থাকে, এই কথাটি এখন প্রায় স্বতঃসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এতটাই ‘স্বাভাবিক’ যে, নেহাত খুনের ঘটনা না ঘটলে সেই অনধিকার চর্চা নিয়ে তেমন আলোড়নও পড়ে না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রবণতাটি আজকের নয়। আনিস খানের মৃত্যুর পর বারে বারেই রিজ়ওয়ানুর রহমানের প্রসঙ্গ উঠেছে। তার একটা বড় কারণ, সেই ঘটনাতেও পুলিশ ভয়ঙ্কর ভাবে নিজের অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে নাগরিকের ব্যক্তিগত পরিসরে হস্তক্ষেপ করেছিল। সেই ঘটনাও সূচনাবিন্দু ছিল না। যে দল যখন ক্ষমতাসীন, তারা তখন পুলিশকে নিজস্ব লেঠেলবাহিনী হিসাবে ব্যবহার করে— এই কথাটি দলনিরপেক্ষ ভাবে সত্য। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, গোটা দেশেই কথাটি কম-বেশি একই রকম সত্য। ২০০২ সালের মার্চে গুজরাতে পুলিশ নিজের সংবিধানসিদ্ধ দায়িত্ব সম্পাদন করেছিল, এই কথাটি বললে দুই দশকের ব্যবধানেও যুগপৎ কান্না এবং হাসির উদ্রেক হবে। কিন্তু, সর্বত্রই পুলিশ এক অনাচারে অভ্যস্ত বলে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে তার এক্তিয়ার লঙ্ঘন বৈধ হয়ে যায় না, এই কথাটি বারে বারে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
কেন পুলিশকে দলীয় লেঠেল হিসাবে ব্যবহার করা হয়, এবং কেনই বা পুলিশ সেই ভূমিকায় ব্যবহৃত হয়, এই দুইটি প্রশ্নের উত্তরই বাঁধা আছে ক্ষমতার সুতোয়। পুলিশের উর্দি বাহিনীকে এমন কিছু অধিকার দেয়, যা সমাজে অন্য স্তরে সহজলভ্য নয়। কোন কাজটি পুলিশের এক্তিয়ারে পড়ে, আর কোনটি পড়ে না, সেই বিষয়ে সাধারণ নাগরিকের ধারণাও স্বভাবতই খুব স্পষ্ট নয়। ফলে, পুলিশকে ব্যবহার করে অনেক কাজ সহজে করিয়ে নেওয়া সম্ভব। অন্য দিকে, রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছাপূরণে ব্যবহৃত হলে যে ক্লায়েন্টেলিজ়মের সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠিত হয়, পুলিশকর্মীদের পক্ষেও তা লাভজনক। আর কিছু না হোক, শাসকের রোষানলে পড়ে বেজায়গায় বদলি হওয়া ঠেকানো সম্ভব এই সম্পর্কের জোরে। এবং, শাসকের সুনজরে থাকলে জবাবদিহির দায়টিও কার্যত আর থাকে না। সব মিলিয়েই এই অবস্থা। পুলিশকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার না করার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বা ক্লায়েন্টেলিজ়মের মোহ অগ্রাহ্য করার মতো বুকের জোর, দুই-ই দুর্লভ। ফলে, এই গোত্রের অভিযোগ বন্ধ হবে বলে আশা করা কঠিন।