কানাই নস্কর কে, সহসা মনে না পড়িতে পারে। গরফা এলাকার মণ্ডলপাড়ার এই প্রৌঢ় নিকটস্থ এক নেশার আসরের প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। পরিণাম, নেশাসক্তদের হাতে প্রহৃত হইয়া তাঁহার মৃত্যু। ২০২০ সালের মহাপঞ্চমীর এই ঘটনায় দুষ্কৃতীদের সহিত পুলিশও নিন্দিত হইয়াছিল। কী করিয়া পাড়ায় পাড়ায় মদ ও মাদকের আসরগুলি অবাধে চলিতে পারে, স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ সত্ত্বেও কেন নেশাদ্রব্যের বিক্রেতা ও ক্রেতাদের শাস্তিদান করা হয় না, সেই প্রশ্ন উঠিয়াছিল। পুলিশ তাহাতে বিচলিত হইয়াছিল, এমন প্রমাণ মেলে নাই। তাই ফের দক্ষিণ কলিকাতায় অবৈধ নেশার আসরে মৃত্যু ঘটিল। নিহত অটোচালক বিশ্বজিৎ জানা নেশার আসরে সংযুক্ত ছিলেন, নেশার সঙ্গীই তাঁহাকে খুন করিয়াছে বলিয়া পুলিশের অনুমান। কিন্তু অভিযুক্তকে জেলে পাঠাইলেই কি সকল কুশলমঙ্গল হইয়া গেল? এলাকার বাসিন্দারা জানাইয়াছেন, রোজ সন্ধ্যায় ওই এলাকায় নেশার আসর বসিতেছে, সেই বিষয়ে তাঁহারা বার বার পুলিশকে জানাইয়াছেন। একাধিক অবৈধ মদের দোকান ব্যবসা করিতেছে, নেশাসক্তরা এলাকার ভদ্র পরিবারগুলিকে নানা ভাবে অপদস্থ করিতেছে, ওই রাস্তাটি সাধারণ নাগরিকের যাতায়াতের অযোগ্য হইয়া উঠিয়াছে, এই সকল কথার কোনওটিই পুলিশের অজানা নহে। তৎসত্ত্বেও কোনও প্রতিকারই পুলিশ করে নাই। যাহার প্রত্যাশিত পরিণাম, ছোটখাটো দুষ্কার্য হইতে শুরু করিয়া অবশেষে ধর্ষণ-হত্যার মতো গুরুতর অপরাধ ঘটিয়া যাওয়া। ইহার জন্য কেবল আততায়ীকে দায়ী করা যথেষ্ট কি?
যে কোনও অপরাধের একটি সামাজিক প্রেক্ষিত রহিয়াছে। নিম্নবিত্ত পরিবার, নগরের দরিদ্রতর এলাকাগুলির শ্রমজীবী যুবকরা নেশা এবং তজ্জনিত নানা অপরাধে জড়াইয়া পড়ে, এই নকশা বিশ্বের সকল দেশেই সত্য। তাহাদের জীবন এতই কঠিন, নিরন্তর পরিশ্রমের পরেও উন্নতির আশা, মর্যাদাপূর্ণ জীবন বাঁচিবার সম্ভাবনা এতই ক্ষীণ যে, বাস্তবকে ভুলিয়া থাকিবার আকর্ষণ প্রবল হইয়া উঠে। মদ ও মাদকদ্রব্য তাহার সহজ পথ, তাই নেশাদ্রব্য সহজে মিলিলে, তাহার অবাধ ব্যবহারে ঝুঁকি না দেখিলে বহু তরুণ সেই দিকে আকৃষ্ট হয়। সামাজিক সঙ্কটের নির্মাণ এই রূপেই হয়, খুনের ন্যায় অপরাধ যাহার চূড়ান্ত প্রকাশ। কিন্তু তাহাই সর্ববৃহৎ সমস্যা নহে। নাগরিক জীবন দাঁড়াইয়া আছে আইনের শাসনের ধারণার উপর। রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়প্রাপ্ত দুষ্কৃতীরা অবাধে নেশার আসর চালাইলে, এলাকার মহিলাদের হয়রান করিলে, সেই আস্থা টলিয়া যায়। নাগরিক তাহার অধিকারের শক্তিতে বাঁচিয়া নাই, ক্ষমতাসীন নেতাদের করুণায় বাঁচিতেছে— এই চিন্তা কেবল ব্যক্তিকে দুর্বল করে না, সমগ্র সমাজকেই ক্লীব করিয়া তোলে।
সুতরাং সমাজকে নেশামুক্ত করিবার কাজটি সহজ নহে। বহু দেশে বৃহৎ মাদকচক্রগুলির সহিত পুলিশের দীর্ঘ লড়াই চলিতেছে, তাহাতে নিহত গোয়েন্দা ও পুলিশের সংখ্যাও কম নহে। আক্ষেপ, ভারতে এই লড়াইতে নাগরিকরাই প্রাণ হারান। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে মেয়েরা চোলাই মদের দোকান ভাঙিয়াছেন। প্রতি বৎসর নেশার আসর হইতে গুরুতর অপরাধের ঘটনা সম্মুখে আসিতেছে। গত মাসেই ডায়মন্ড হারবার রেলকলোনির মাঠে মদ-গাঁজার আসরের প্রতিবাদ করিয়া পায়ে গুলিবিদ্ধ হইয়াছেন এক তরুণ। গুরুতর অপরাধগুলির একটি বড় অংশের সহিত মদ ও মাদকের সম্পর্ক রহিয়াছে। গার্হস্থ হিংসার সহিত মদের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। তবু যে অপরাধগুলি চলিতেছে, তাহার কারণ আইনের শাসন এই রাজ্যে অনেকাংশে একটি ধারণামাত্র। যত দিন না ইহা ‘ধারণা’ হইতে বাস্তবে পরিণত হইবে, নেশা নামক পরিব্যাপ্ত শত্রুর সঙ্গে লড়াই আরম্ভ করাও সম্ভব নয়।