নদী যেমন স্রোত হারাইয়া শৈবালদামে বাঁধা পড়ে, জীবনহারা জাতি তেমনই জীর্ণ লোকাচারে। প্রতি বৎসরের ন্যায় এই বারেও ছট পূজার দিন বিষাক্ত ফেনায় পরিপূর্ণ যমুনায় পূজার্চনার চিত্রসমূহ কবির বাণীই স্মরণে আনিয়া দিল। মুম্বই শহরে গণেশ পূজার বিসর্জনে আরব সাগরের সৈকত আবর্জনায় ভরিয়া উঠে, দুর্গা পূজার প্রতিমা বিসর্জনকালে সুবিপুল সঙ্কটের সাক্ষী হয় কলিকাতার গঙ্গা, দুই মাস অন্তর হরিদ্বারের হর কী পৌড়ীতে নদী পরিষ্কার কার্যের পর প্লাস্টিক ব্যাগ, মালা, মুদ্রার স্তূপ জমা হয় তীরে। এ কথা সত্য যে, নদীর সহিত সভ্যতার জন্মাবধি যোগ, তাহাকে লোকাচার হইতে ছিন্ন করা সহজ নহে। কিন্তু, দীর্ঘ দিনের অপব্যবহারে নদী যে নিজেকে শোধন করিবার প্রাকৃতিক ক্ষমতাটি হারাইয়া ফেলে, এই স্বাভাবিক জ্ঞানটি লোপ পাইলেই মুশকিল।
এই বিপদ যদিও হিমশৈলের চূড়ামাত্র। নদীর বাস্তুতন্ত্রের প্রধান হন্তারক বিষাক্ত শিল্পবর্জ্য, তাহাকে ছাড়িয়া শুধু ধর্মাচারকে দুষিবার অর্থ, বিপদ হইতে মুখ ফিরাইয়া থাকা। অতএব, ভারতের যে তীব্র জলদূষণ সমগ্র বিশ্বেরই মাথাব্যথার কারণ হইয়া উঠিতেছে, যাহা লইয়া আন্তর্জাতিক স্তরে বৈঠক সমীক্ষা গবেষণার অন্ত নাই, তাহাকে এমন খণ্ড ক্ষুদ্র করিয়া দেখিলে সমস্যার মূলে পৌঁছানো যাইবে না। জানিতে হইবে, ভারতে জলদূষণের প্রধান তিন উৎস অপরিশোধিত পয়ঃপ্রণালী, জৈব বর্জ্য এবং জলে ‘কলিফর্ম’-এর অতিরিক্ত (এক প্রকার ব্যাকটিরিয়া) মাত্রা। বুঝিতে হইবে, যে নদী পানীয় জলের উৎস এবং জলজ বাস্তুতন্ত্রের আধার, তাহাতেই কিছুমাত্র শোধিত না হইয়া ক্রমাগত মিশিতে থাকে পয়ঃপ্রণালীর জল, কেননা তাহা পরিশোধনের ব্যবস্থা কোথাও অপ্রতুল, অন্যত্র জরাজীর্ণ। কঠিন বর্জ্যের চাপে নদীতে প্রাণের অস্তিত্বও ক্রমশ ক্ষীয়মাণ, বিপুল ফেনারাশি জৈবতন্ত্রের মৃত্যুর প্রমাণ। অতিমাত্রায় ‘কলিফর্ম’ সেচের জলকে দূষিত করে, যাহা হইতে জন্ম লয় রোগব্যাধি। এই সকল বিষয়ের প্রতিকার না খুঁজিলে জলদূষণ হইতে মুক্তির পথটুকু মিলিবার আশাও কুহকিনী।
প্রশ্ন তাই করিতে হয় প্রশাসনকে। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অধীনে দেশ জুড়িয়া যে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলি প্রস্তুত হইয়াছিল, এক্ষণে তাহার অবস্থা কী? গঙ্গা-যমুনা প্রভৃতি নদীর পুনরুজ্জীবনের যে ঢক্কানিনাদ মাঝেমধ্যেই শুনা যায়, তাহার বাস্তবতাই বা কত দূর? একটি আরটিআই রিপোর্ট অবশ্য বলিতেছে, নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রথম চার বৎসরে ‘নমামী গঙ্গে’ প্রকল্পে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন বাবদ ৩৬.৪৭ কোটি টাকা খরচ হইলেও— যে বিজ্ঞাপনের প্রতিটিতে প্রধানমন্ত্রীর জ্বলজ্বলে উপস্থিতি— তাহার অধীন অধিকাংশ কার্য অদ্যাবধি শুরুই করা যায় নাই। স্মরণে থাকিবে, দিল্লি সরকার যখন যমুনার দূষণের কারণে ছট পূজার আচার-অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞার কথা চিন্তা করিতেছিল, তখন তাহার প্রবল প্রতিবাদে গোলমাল পাকাইয়াছিল বিজেপি, ধর্মীয় রং চড়িতেও বাকি ছিল না। যে শাসকের উদ্দেশ্য-বিধেয় সকলই সঙ্কীর্ণ রাজনীতিকে কেন্দ্র করিয়া আবর্তিত, তাহার নিকট পরিবেশবান্ধব প্রতিমা বানাইবার অথবা বিসর্জনের বিকল্প স্থান চিহ্নিতকরণের ন্যায় দূষণরোধী প্রকল্প গুরুত্ব না পাওয়াই স্বাভাবিক। নদীর গরলপুঞ্জ দেখিয়া সচকিত হইয়া উঠা, এবং অতঃপর তাহা ভুলিয়া যাওয়া— ইহাই কি ভবিতব্য?