বৎসরভর বুক বাজাইয়াও যে ছাত্র পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়, প্রতিবেশীরা তাহাকে লইয়া মুচকি হাসিতেই পারেন, কিন্তু ঘরের লোককে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইতে হয়। ভাবনার কারণ দুইটি— অসাফল্য তো বটেই, তদুপরি ঢাক বাজাইবার বহর। ভারতবাসীর দশাও সম্ভবত তদ্রূপ। টিকাকরণে সাফল্য প্রচারের ঢক্কানিনাদে কান পাতা দায়, অপিচ বিশ্বজোড়া টিকা-মানচিত্রে ভারত এক পশ্চাৎপদ দেশ, অর্ধেক নাগরিকও অদ্যাবধি সুরক্ষিত নহেন। যথা, গত ২১ অক্টোবর এক শত কোটি টিকাকরণ সম্পন্ন করিবার মুহূর্তটি মহা ধুমধামে উদ্যাপন করিলেন প্রধানমন্ত্রী, বক্তৃতামালা হইতে বিচিত্রানুষ্ঠান সকলই হইল। কিন্তু এক শত চল্লিশ কোটি জনতার দেশে ইহা যে হর্ষান্বিত হইবার ক্ষণ নহে, তাহাও যখন একটি ডোজ়মাত্র— এই জরুরি সত্যটি মুখ লুকাইল। অন্তরালে রহিয়া গেল আরও কিছু জরুরি কথা: বহু সরকারি কেন্দ্রে টিকার আকাল চলিতেছে, কিছু রাজ্যে টিকা সরবরাহ অনিয়মিত, জনতার একাংশ টিকাগ্রহণে সচেতন নহেন, সর্বোপরি স্মার্টফোনহীন নাগরিকগণ টিকার শংসাপত্র লইয়া বিভ্রান্ত। আক্ষেপের কথা, কাহিনিসকল প্রধানমন্ত্রীর সহাস্য মুখমণ্ডল ছাপাইয়া আলোকবৃত্তে উঠিয়া আসিতেছে না।
টিকাকরণ কোভিড মোকাবিলার একটি ক্ষেত্র। অন্যান্য ক্ষেত্রেও ভারতের রিপোর্ট-কার্ড গৌরবের নহে। বিপর্যয় সামলাইবার ক্ষমতা, এমনকি ইচ্ছার কমতিও স্পষ্ট ধরা পড়িয়াছিল গত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে, যখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কায় সরকারকে বারংবার সতর্ক করিতেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিন্তু সেই সময়ে সপার্ষদ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা জয়ে মন দিয়াছিলেন। যে লগ্নে জনতার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ছিল, তখন লক্ষাধিক মানুষের জনসমাবেশে ভাসিয়াছে ভারত। তাহার পরিণতিতে যখন ভয়ালতর রূপে কোভিড আসিয়া পড়িল, হাসপাতাল শয্যা ও অক্সিজেন লইয়া দেশময় হাহাকার উঠিল, গঙ্গাবক্ষে মৃতদেহের রাশি ভাসিল, তখনও সরকার ছিল মূলত দর্শকের ভূমিকায়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব অস্বীকার পর্যন্ত করিল। প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী দূরদর্শনে আসিয়া কয়েক বিন্দু অশ্রু বিসর্জন করিলে অতিমারি সামলাইবার কিছুমাত্র সুরাহা হয় না। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ ভারতের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়। প্রচারই যাহাদের অভীষ্ট, তাহারা বিজ্ঞাপনে মনোনিবেশ করিয়া ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব এড়াইলে এমনই হইবার কথা।
বৎসর-শেষে ওমিক্রন নামক অতি-সংক্রামক ভেরিয়্যান্ট যখন তৃতীয় ঢেউয়ের চোখ রাঙাইতেছে, তখনও গত দুই বৎসরের বিফলতার পথ হইতে অপসৃত হইবার লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। এক্ষণেও উত্তরপ্রদেশ ভোটের জন্য নিয়মিত জনসভা করিতেছেন প্রধানমন্ত্রী, অন্তত দুই লক্ষ জনসমাগম হইতেছে, যে বিষয়ে আদলতকেও সতর্কবাণী ঘোষণা করিতে হইয়াছে। অপর পক্ষে সরকারি তথ্য বলিতেছে, ৩১ ডিসেম্বরের ভিতর সমগ্র দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে টিকা দিবার প্রতিশ্রুতি পালিত হয় নাই, এমনকি ১১ কোটি মানুষ একটি ডোজ়ও পান নাই। প্রশ্ন আরও। অপরাপর দেশে তিন বৎসরের ঊর্ধ্বে টিকাকরণ শুরু হইলেও ভারতে কেন সেই বয়সসীমা পনেরো হইতে আঠারোয় বাঁধিয়া দেওয়া হইল? সামাজিক অনুষ্ঠানে দুই শত জনের ঊর্ধ্বসীমা থাকিলেও কেন উৎসবের জমায়েতে রাশ টানা হইতেছে না? ওমিক্রন খুঁজিতে কেন পরীক্ষা বাড়ানো হইতেছে না? সরকারের ক্রিয়াকলাপে যদিও এইরূপ প্রশ্নে ভাবিত হইবার চিহ্ন নাই। প্রথম দুই ঢেউয়ে কাজ খোয়াইয়াছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা, ডুবিয়াছে ক্ষুদ্র ও মধ্য মাপের ব্যবসা, চিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারাইয়াছেন অগণিত নাগরিক। ইহার পরেও যে সরকার সক্রিয় নহে, তাহার ‘কল্যাণে’ দেশের ভবিষ্যৎ অকল্যাণে ডুবিবার উপক্রম।