হায়দারপোরায় সেনা-পুলিশ যৌথ অভিযানে চার ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায়— যাহার ভিতর তিন জন সাধারণ নাগরিক, এক জন পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদী বলিয়া অভিযুক্ত— জম্মু ও কাশ্মীরে সর্বস্তরে হইচই পড়িয়াছে। পড়িবারই কথা— প্রাথমিক ভাবে প্রত্যেকের সহিত সন্ত্রাস-যোগের কথা শুনা গিয়াছিল, পরিবারের অগোচরে তাহাদের শেষকৃত্যও সম্পন্ন হইয়াছিল, শেষে আবার দুই জনের দেহ পরিবারের হাতে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। ‘সাধারণ নাগরিক’-এর হত্যায় প্রশাসনিক তদন্তের নির্দেশ আসিয়াছে, রাজনৈতিক দলগুলি বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাইয়াছে। বুঝিতে অসুবিধা নাই, এমন ঘটনায় উপত্যকার মানুষ এবং ভারত সরকারের ভিতর ফাটল আরও কিছু প্রশস্ত হইল। গত বৎসর শোপিয়ানে সেনার গুলিতে তিন নিরপরাধ নাগরিকের প্রাণ গিয়াছিল। সেই তদন্তে তিন সেনাকর্তা দোষী সাব্যস্ত হইলেও আদালতে তাঁহাদের বিচারপ্রক্রিয়া অদ্যাবধি শুরু হয় নাই। বিচারপ্রার্থী জনতার বিশ্বাসও তাই ক্ষীয়মাণ।
মূল প্রশ্নটি দায়িত্বের। ‘উপদ্রুত’ এলাকা শান্ত করিবার গুরুত্বদায়িত্ব যে বাহিনীর স্কন্ধে ন্যস্ত, এবং যাহারা আফস্পা-র ন্যায় বিশেষ শক্তিশালী আইনে বলীয়ান, সাধারণ নাগরিক ও সন্ত্রাসবাদীর ভিতর ফারাক করিবার কর্তব্য তাহাদেরই। নাগরিকের জীবন বাঁচাইতে যাঁহারা যুদ্ধে নামিবেন, নাগরিককে সর্বাগ্রে চিনিয়াও লইতে হইবে তাঁহাদের। ইদানীং উপত্যকার বিভিন্ন অভিযানে কিছু নাগরিকের গাত্রে ‘সন্ত্রাসী-সহায়ক প্রকাশ্য কর্মী’ বা ‘সঙ্কর সন্ত্রাসবাদী’র যে তকমা পড়িয়া যাইতেছে, তাহা কিন্তু এই ফারাক করিবার কাজটি কঠিন করিয়া দিয়াছে। এবং, এই ভাবে সেই বুনিয়াদি প্রক্রিয়ার গুরুত্বও লঘু হইয়া যাইতেছে, হায়দারপোরায় ঘটনা যাহার পাথুরে প্রমাণ। ভুলিলে চলিবে না যে ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট বলিয়াছিল, কাহাকেও সন্ত্রাসবাদী চিহ্নিত করিবার পূর্বে ‘‘কোনও না কোনও স্পষ্ট হিংসাত্মক ঘটনার নির্দেশ বা প্রচেষ্টা বা আভাস থাকিতে হইবে।’’ আদালতের রায়টি প্রণিধানযোগ্য— সংবিধানের ২১ নং ধারা অনুসারে দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই মৌলিক অধিকার স্বীকৃত, অতএব যথাযথ ভাবে সন্ত্রাসবাদী চিনিবার কাজটিও সমান জরুরি।
রাষ্ট্র ও নাগরিকের ভিতর অবিশ্বাসের ভাঙা সেতুটি জুড়িবার কাজে অগ্রগণ্য ভূমিকা লইতে পারিতেন রাজনীতিকরা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর জমানায় তাহা হইবার নহে। বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর হইতে কাশ্মীরের স্থানীয় রাজনৈতিক স্বর অবদমিত, অবশিষ্টাংশ নীরব বশ্যতার শিকার। জনতার বিশ্বাস অর্জন করিতে তাঁহাদের সহিত আলাপে যাইতে হয়, এই স্থলে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কথা শুনিবারই কেহ নাই, আলোচনা দূরস্থান। বস্তুত যে সরকার উপত্যকায় জঙ্গি কার্যকলাপ সত্ত্বেও সন্ত্রাসদমনের সাফল্যে ডগমগ, যাহারা উগ্রপন্থার প্রতি যুবসমাজের ক্রমবর্ধমান ঝোঁক দেখিয়াও ভূস্বর্গের পর্যটন-বিজ্ঞাপনেই সর্বাধিক মনোযোগী, তাহাদের নিকট এই সঙ্কট সমাধানের দুরাশা না করাই ভাল। এই সঙ্কীর্ণ রাজনীতির উদ্দেশ্য-বিধেয় পৃথক, জনতাকে অবজ্ঞা করিয়াই তাহার চলিবার পথ। নাগরিককে সুবিচার দিতে যে সদিচ্ছার প্রয়োজন, এই রাজনীতিতে তাহা অনুপস্থিত। নাগরিকের আস্থা অর্জনও তাহার কর্ম নহে।