সম্প্রতি স্কুল খুলিবার দাবিতে সরব হইলেন বাংলার শিক্ষক ও অভিভাবকরা। অপ্রত্যাশিত নহে। এই অতিমারিকালে পঠনপাঠনের প্রতি যে উপেক্ষা যুগপৎ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার দেখাইয়াছে তাহা মানুষকে বিস্মিত ও ব্যথিত করিয়াছে। বিশেষত রাজ্য সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত অর্থহীন ঠেকিয়াছে। জনসমাজ হইতে বার বার প্রশ্ন উঠিয়াছে, কোভিড সংক্রমণ ছড়াইবার অপর সকল পথ মুক্ত রাখিয়া, এমনকি নির্বাচনী সভা অথবা বিবিধ ধর্মোৎসব উপলক্ষে জনসম্মেলনেও নিষেধাজ্ঞা না ঘোষণা করিয়া, কেবল স্কুলই বন্ধ রাখা হইতেছে কেন? সংক্রমণের আভাসমাত্র মিলিলে সকলের পূর্বে স্কুল বন্ধ হইয়াছে, এবং সকলের পরে খুলিয়াছে, প্রাথমিক হইতে উচ্চ মাধ্যমিক, সকল স্তরের বিদ্যালয় কার্যত স্থগিত হইয়াছে। শিশুদের স্বার্থেই সরকার এমন সিদ্ধান্ত, এই যুক্তি অন্তত তৃতীয় ঢেউয়ে দুর্বল লাগিতেছে, কেননা আপাতত টিকাকরণও ধীরে হইলেও শুরু হইয়াছে। অথচ ইতিমধ্যে পঠন-পাঠনের সহিত ছাত্রছাত্রীরা কার্যত বিযুক্ত হইয়াছে। সরকারি স্কুলগুলির অধিকাংশ পড়ুয়ার নিকট অনলাইন পাঠদানের প্রযুক্তি পৌঁছায় নাই, হয়তো পৌঁছাইবার কথাও নহে। সাপ্তাহিক লিখিত প্রশ্নোত্তর আদান-প্রদান নিয়মিত পঠনপাঠনের অতি সামান্য অংশ মিটাইতে পারিয়াছে। মিড-ডে মিলের মতো প্রকল্প, যাহা এই দুঃসময়ে শিশুর নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ হইয়াছিল, তাহাও অত্যন্ত উপেক্ষিত হইয়াছে। শিশুর সুষম আহার পাইবার অধিকার মিটাইবার কোনও চেষ্টাই সরকার করে নাই, চাল-আলু বিতরণ করিয়া নিয়মরক্ষা ব্যতিরেকে।
সর্বাপেক্ষা দুঃখের কথা: কোনও বিকল্প উপায় সন্ধান করে নাই সরকার। কেবল পশ্চিমবঙ্গে নহে, দেশের প্রায় কোথাও তেমন প্রচেষ্টা হয় নাই। স্কুল আংশিক খোলা রাখিয়া, বিভিন্ন দিনে কিছু কিছু ছাত্রছাত্রীকে আনিয়া, স্কুল ও পড়াশোনার সহিত ছাত্রদের সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব কি না, সেই আলোচনাও শিক্ষক ও অভিভাবকদের সহিত ঘটে নাই। দীর্ঘ দিন পরে স্কুল খুলিলেও, শিক্ষক ও পড়ুয়াদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখিয়া স্কুল চালাইবার রীতি কী হইবে, তাহার বিধি তৈরি করে নাই। ইহার প্রত্যাশিত ফলই ফলিয়াছে— দুই বৎসরে অগণিত ছাত্রছাত্রী স্কুলছুট হইয়াছে। শ্রেণিকক্ষের পড়ুয়া হইতে শিশুশ্রমিক, নাবালিকা বধূ ও জননী হইবার হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলি সকলের চক্ষের সম্মুখেই ঘটিয়াছে। সরকারি স্কুলগুলি কার্যত বন্ধ রাখিবার ফলে শিক্ষায় বৈষম্য আরও গভীর হইয়াছে। শহরে ব্যয়বহুল বেসরকারি স্কুলগুলিতে নিয়মিত ডিজিটাল মাধ্যমে পঠনপাঠন হইয়াছে। গ্রামের দরিদ্র এলাকার সরকারি স্কুলগুলিতে অনলাইন শিক্ষাদান হয় নাই, হইলেও বিপুল সংখ্যক পড়ুয়া তাহার নাগাল পায় নাই। ডিজিটাল বিভাজন দেখাইয়াছে, শিক্ষার দ্বারা সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করিবার লক্ষ্য হইতে রাজ্য ক্রমশই ভ্রষ্ট হইয়াছে। তাহার প্রমাণস্বরূপ পরিসংখ্যানও ক্রমশ জড়ো হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম এবং নাগরিক সংগঠনগুলি তাহা লইয়া শোরগোল কম করে নাই। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করে নাই।
অভিভাবক ও বৃহত্তর নাগরিক সমাজের ক্ষোভ অনেকটাই বর্ষিত হইতে দেখা যায় শিক্ষকদের উপর। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাবঞ্চিত, অথচ মাস্টারমহাশয়রা সবেতন ছুটি কাটাইতেছেন, এই অভিযোগ ক্রমশ সজোর। অতএব আজ খুদে পড়ুয়া, তাহার অভিভাবক, তাহার শিক্ষক, সকলেই স্কুল খুলিবার দাবিতে পথে নামিতেছে। কেন পথে না নামিলে, মিছিল ও অবস্থান করিয়া নাগরিক জীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করিলে সরকার নাগরিকের কথায় কর্ণপাত করে না? স্কুল খুলিবার দাবিপত্র লইয়া যে বালিকা রাস্তায় হাঁটিতেছে, আপন দেশের সম্পর্কে যে শিক্ষাটি পাইল, তাহা সহজে ভুলিবে না।