ফাইল চিত্র।
শীতের সূচনায় দিল্লিতে দূষণ নূতন ঘটনা নহে। কিন্তু দূষণজনিত কারণে রাজধানীতে প্রায় লকডাউনের আবহ ইতিপূর্বে বিশেষ দেখা যায় নাই। স্কুল-কলেজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ, কর্মস্থলে উপস্থিতি নিয়ন্ত্রিত, নির্মাণকার্য সাময়িক ভাবে স্থগিত। দূষিত শহরে বৃদ্ধি পাইতেছে শ্বাসনালি ও ফুসফুসে সংক্রমণজনিত সমস্যা। এ-হেন দূষণের প্রধানতম কারণ হিসাবে দিল্লি সরকার এযাবৎ কাল দায়ী করিত পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে কৃষকদের ফসলের গোড়া পোড়ানোকে। কিন্তু সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রের হলফনামা বলিতেছে, দূষণের মূল কারণ কলকারখানার বর্জ্য ও গ্যাস, যানবাহনের ধোঁয়া এবং সূক্ষ্ম ধূলিকণা। স্পষ্টতই দূষণের এই ‘অন্য’ কারণগুলি কেজরীবাল সরকার এত দিনেও নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে নাই। কেন পারে নাই, সেই প্রশ্ন তুলিয়াছে সর্বোচ্চ আদালতও।
এই চিত্র সবিশেষ শঙ্কার। পরিবেশকে শেষাবধি এমন বিপর্যয়ের সম্মুখে দাঁড় করাইল নাগরিক সভ্যতা যে, দৈনন্দিনতার ছন্দটিকেই উলটপালট করিতে হইতেছে। শুধুমাত্র দিল্লি নহে, সামগ্রিক ভাবে ভারতে বায়ুদূষণের কারণগুলি সকলেরই জানা। তৎসত্ত্বেও কলকারখানা, যানবাহনের ধোঁয়া, ফুটপাতের দোকানে জ্বালানির দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায় নাই। ১৫ বৎসরের অধিক পুরাতন গাড়ি বাতিলের কেন্দ্রীয় সরকারি নীতি প্রয়োগ করিতে ঢের বিলম্ব হইয়াছে এবং উৎসবে বাজির ব্যবহারও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা যায় নাই। সমস্যা অন্যত্রও। ছয় বৎসর পূর্বে কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ুমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর জানাইয়াছিলেন, দিল্লি-সহ দেশের ছয়টি মেট্রো শহরের বায়ুদূষণের উৎসের নেপথ্যে ২২-২৩ শতাংশই নির্মাণ-বর্জ্যের দূষণ দায়ী। নির্মাণকার্যের সময় বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়, যাহা বায়ুদূষণ ঘটায়। এই নির্মাণ-বর্জ্যের দূষণের নিরিখে দিল্লির তুলনায় কলিকাতা খুব বেশি পিছাইয়া নাই। অথচ, শীতকালে শহরে নির্মাণকার্যে নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হইবে কি না, তাহা লইয়া পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও আলোচনার স্তরেই সীমাবদ্ধ। কলিকাতার প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, সামগ্রিক ভাবে এই শহরে বায়ুদূষণের হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শুধুমাত্র ধাপা অঞ্চলে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ মাসে ১ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা। অথচ, বায়ুদূষণ লইয়া বৎসরভর কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সরকারি তরফে এখনও চোখে পড়ে নাই।
বস্তুত, দিল্লির সাম্প্রতিক অবস্থা হইতে অনেক কিছু শিক্ষণীয়। দূষণ ঠেকাইতে লকডাউনের প্রস্তাবটি যুক্তিসঙ্গত। মানুষ রাস্তায় কম নামিলে দূষণে শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা কমে। অন্য দিকে, যানবাহন কম চলিলে দূষণের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকে। সুতরাং, অন্যান্য রাজ্যও এই পথে ভাবিয়া দেখিতে পারে। ভাবিতে হইবে, অতিমারির কারণে যে ঘর হইতে কাজের সংস্কৃতির সূচনা হইয়াছে, দূষণের ক্ষেত্রেও তাহা কার্যকর হইতে পারে কি না। তবে ইহা শুধু সরকারের দায় নহে। দৈনন্দিন জীবনযাপনকে কী ভাবে আরও পরিবেশবান্ধব করিয়া তোলা যায়, ভাবিতে হইবে নাগরিককেও। পরিবর্তন আনিতে হইবে জীবনযাত্রার ধরনে। মনে রাখিতে হইবে, এই সমস্যাগুলি স্থানীয়। সামান্য কিছু রদবদলেই ইহার মোকাবিলা সম্ভব। সেই কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন। পরিবেশের প্রশ্নে, সামগ্রিক ভাবে নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে।