লক্ষণ দেখিয়া রোগ নির্ণয়— ডাক্তারি পরিভাষায় যাহাকে ‘ডায়াগনোসিস’ বলে— চিকিৎসকেরা তাহাই করিয়া থাকেন। কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশে এক চিকিৎসক আগত রোগীর রোগ নির্ণয় করিলেন, কোভিড নহে, ডেঙ্গি নহে, তাঁহার অসুখটি ‘জলবায়ু পরিবর্তন’! রোগীর শ্বাস লইতে কষ্ট হইতেছিল, তাহা হইলে হাঁপানি বা ফুসফুসের অসুখ বলা হইতেছে না কেন? কারণ, চিকিৎসক বিবেচনা করিয়া দেখিয়াছেন, রোগী যে স্থান হইতে আসিয়াছেন সেই অঞ্চলটি চলতি অর্থবর্ষে ১৬০০-রও বেশি দাবানলে দগ্ধ। সেই প্রাকৃতিক ঘটনার জেরে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ও তাপপ্রবাহ রোগীর শ্বাসকষ্ট বহুগুণ বাড়াইয়া তুলিয়াছে। স্বাভাবিক অবস্থায় যে অসুখ নিয়ন্ত্রণযোগ্য, জলবায়ু পরিবর্তন তাহাকেই করিয়া তুলিতেছে ভয়াবহ, প্রায় দুশ্চিকিৎস্য।
বলা হইতেছে, বিশ্বে এ-হেন ঘটনা এই প্রথম। এই প্রথম কোনও রোগীর অসুখ হিসাবে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ লেখা হইল। ইহা শুনিতে আশ্চর্য, মানিতে মুশকিল, ভাবিলে ভয়ঙ্কর। সাধারণ মানুষ মোটের উপর জানেন জলবায়ু পরিবর্তন লইয়া বিশ্বে সমস্যা হইতেছে, আলোচনা-সম্মেলনও— কিন্তু তাহা যে এই ভাবে অসুখ হইয়া হাসপাতালে ঢুকিয়া পড়িবে, কল্পনাতীত ছিল। তাহাই বাস্তব হইয়াছে। কানাডার ওই চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা, সাম্প্রতিক কালের রেকর্ড তাপপ্রবাহের পরে মানুষের মধুমেহ, হৃদ্রোগ ও শ্বাসকষ্ট ত্বরান্বিত হইয়াছে। জলবায়ু পরিবর্তন কেবল দূরদেশে বা অন্য গোলার্ধেই কালান্তক হইতেছে ভাবা নিতান্ত মূর্খামি— ভারতও প্রতি বৎসর তাপপ্রবাহে পুড়ে, শীতের শুরুতে নিয়ম করিয়া মাত্রাছাড়া বায়ুদূষণের শিকার হয়, দিল্লিতে যমুনার জল সাদা পুরু ফেনায় কেমন ভরিয়া উঠে তাহা সকলেরই জানা। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, এমনকি তাপপ্রবাহও স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা, কিন্তু অস্বীকারের উপায় নাই, মানুষের অসংযম ও প্রাকৃতিক সম্পদের অসদ্ব্যবহার সেই স্বাভাবিককেও অস্বাভাবিক করিয়া তুলিয়াছে, এত দূর যে তাহা বুমেরাং হইয়া আঘাত করিতেছে মানুষের সুস্থতাকেই। কানাডীয় চিকিৎসক বলিয়াছেন, শুধু বহিরঙ্গের রোগলক্ষণই নহে, এখন দরকার সেই উপসর্গের পিছনের কারণ নির্ণয়, তাহা না হইলে জলবায়ু পরিবর্তনের সহিত দৌড়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান সত্বর পিছাইয়া পড়িবে।
তবে কি রোগীর ব্যবস্থাপত্রে রোগের কারণ হিসাবে করোনাভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণের পাশে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’, ‘বায়ুদূষণ’ ইত্যাদিও জ্বলজ্বল করিবার দিন আসিল? মনে রাখা দরকার, চিকিৎসকের এ-হেন রোগনির্ণয় সত্য হইলেও তাহা লিখিবার ক্ষেত্রে বাধা আসিতে পারে। বাধা দিতে পারে প্রশাসন, সরকার তথা রাষ্ট্র— কারণ পরিবেশ, প্রকৃতি ও জলবায়ু রক্ষায় ইহাদের দায়িত্ব কম নাই, এবং সেই দায়িত্ব পালনে ঘাটতিও কম নাই। কোভিড-প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিনগুলি মনে পড়িতে পারে— রোগীমৃত্যুর কারণ হিসাবে করোনাভাইরাস না অন্যতর পরিস্থিতি, কী লেখা হইবে তাহা লইয়া বিস্তর জল ঘোলা হইয়াছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের দায় লইতে অস্বীকৃত রাষ্ট্রযন্ত্র চিকিৎসকের উপর খড়্গহস্ত হইতে পারে, রোগের কারণ হিসাবে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ লেখা যাইবে না। সেই অবসরে নূতন এই রোগ বিশ্বময় ছড়াইয়া না পড়ে। হায়, ইহার তো ভ্যাকসিনও নাই।