জ্যোতির্গময়

ভারতের শতবার্ষিকী বিবর্তন অবশ্যই চরিত্রে বহুমাত্রিক, হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক আগ্রাসন সেই বিবর্তনের একটি দিক

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২২ ০৮:০২

দোলপূর্ণিমা তিথিতে এই সংবাদপত্রের জন্ম। তাহার জন্মতিথির শতবর্ষ পূর্ণ হইবে আগামী শুক্রবার। তিথির হিসাব চন্দ্রমুখী। সূর্যের হিসাব স্বতন্ত্র। সৌরবর্ষের নিয়মে বাঁধা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মতে এই পত্রিকার সূচনা হইয়াছিল ঠিক এক শত বৎসর পূর্বে আজিকার তারিখটিতে। মহাকালের মাপকাঠিতে শতাব্দী ক্ষণমাত্র বটে, কিন্তু মানুষের পক্ষে শতাব্দী অল্প সময় নহে। দেশ বা জাতির জীবনে এক শত বৎসরে কল্পান্তর সম্ভব। তাহার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাইতে পারে। ১৯২২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা যে দিন প্রথম প্রকাশিত হয়, তাহার তিন দিন পূর্বে ব্রিটিশ রাজের পেয়াদারা সবরমতী আশ্রম হইতে গান্ধীজিকে গ্রেফতার করিয়াছিল। চৌরিচৌরা কাণ্ডের পরিণামে অসহযোগ আন্দোলন তত দিনে স্থগিত হইয়াছে, কিন্তু অসহযোগের আদর্শে কংগ্রেস অবিচল, অতএব গান্ধীজিকে মুক্ত রাখিতে রাজশক্তি ভরসা পায় নাই। ২০২২ সালে সেই তারিখটি যখন ফিরিয়া আসিল, তাহার তিন দিন পূর্বে স্বাধীন ভারতের বৃহত্তম রাজ্যে জনাদেশ জিতিয়া ক্ষমতায় ফিরিয়াছেন যোগী আদিত্যনাথ, ক্ষমতা-সফল হিন্দুত্ববাদের গৈরিক উল্লাস আকাশ বিদীর্ণ করিয়াছে, কংগ্রেসকে এই সমকালীন ইতিহাসের পাদটীকা বলিলেও অত্যুক্তি হয়। এক শত বৎসরে ভারত কোথা হইতে কোথায় পৌঁছাইল, এই দৃষ্টান্তটি তাহা নির্মম ভাবে জানাইয়া দেয়। আপন বক্ষে সেই পরিবর্তনের পদচিহ্ন ধারণ করিতেছে শতায়ু সংবাদপত্র। তাহাই সংবাদপত্রের কর্তব্য, ধর্ম এবং বিধিলিপি।

ভারতের শতবার্ষিকী বিবর্তন অবশ্যই চরিত্রে বহুমাত্রিক, হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক আগ্রাসন সেই বিবর্তনের একটি দিক। ভুলিলে চলিবে না যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কূটনৈতিক ভূমিকা, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার— নানা দিক হইতেই ভারত জগৎসভায় বেশ কিছুটা গুরুত্ব অর্জন করিয়াছে। উপনিবেশের অন্তিম লগ্নে স্বাধীন দেশের ভবিষ্যৎ লইয়া যে গভীর সংশয় দেখা দিয়াছিল, সাতচল্লিশ-উত্তর ইতিহাস তাহাকে বহুলাংশে অমূলক প্রমাণ করে, বহু সঙ্কট এবং বিস্তর ত্রুটি সত্ত্বেও স্বাধীন সার্বভৌম ভারতের সামর্থ্য ও প্রত্যয়কে, বিশেষত তাহার গণতন্ত্রের আত্মশক্তিকে সমগ্র বিশ্ব স্বীকার করিতে বাধ্য হয়। তেমনই, বহুমাত্রিক দারিদ্র এবং অসাম্যের প্রবল প্রকোপ সত্ত্বেও মানিতেই হইবে, ভারতীয় অর্থনীতি স্বাধীনতার পরে, বিশেষত গত তিন দশকে আর্থিক সংস্কারের কল্যাণে দুনিয়ার অন্যতম প্রধান অর্থনীতি বলিয়া গণ্য হইয়াছে; এই স্বীকৃতি তুচ্ছ করিবার নহে। সংবাদপত্রের পাতা উল্টাইলে এই অগ্রগতির অগণন প্রতিফলন দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাহা নিছক সাফল্যের সূচকে নহে, সমস্যার সূচকেও— দেশের সমস্যার চেহারা-চরিত্র কী ভাবে বদলাইয়াছে, হতদরিদ্র দেশের জীবনসংগ্রাম কী ভাবে উন্নয়নকামী অর্থনীতির অভিযাত্রায় রূপান্তরিত হইয়াছে, তাহার চিত্রগুলিও অনেক ক্ষেত্রেই পরোক্ষ ভাবে এই দেশের বিপুল সম্ভাবনার সংবাদ ঘোষণা করে।

Advertisement

কিন্তু সেই অগ্রগতি এবং সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটেই প্রকট হইয়া উঠে বাস্তবের অন্য দিকটিও। সেই বাস্তব আলো হইতে অন্ধকারের অভিমুখে পশ্চাদপসরণের। সেই অন্ধকার দারিদ্র ও অসাম্যের, সঙ্কীর্ণতা এবং বিদ্বেষের। পঁচাত্তর বৎসর পূর্বে স্বাধীনতার সূচনালগ্নে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মধ্যরাত্রির ঐতিহাসিক ভাষণে যে সর্বজনীন উন্নয়নের সঙ্কল্প ঘোষিত হইয়াছিল, তাহা আজও বহুলাংশে অপূর্ণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসী সেই অগ্রগতিতে অংশীদার হইতে ব্যর্থ, বৃহদাংশিককে সুযোগবঞ্চিত রাখিয়া ন্যূনাংশিকের সমৃদ্ধি উন্নয়নের সার্থকতাকে সঙ্কীর্ণ বলয়ে সীমিত রাখিয়াছে। সঙ্কীর্ণতা কেবল অর্থনীতির বিচারে নহে, সমাজ ও রাজনীতির ভুবনেও তাহার প্রকোপ অতিমাত্রায় প্রবল। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, জাতপাত, আঞ্চলিকতা, গোষ্ঠীবাদ ইত্যাদি সহস্র ব্যাধি সার্বজনিক গণতন্ত্রের কাঠামোটিকে ক্রমাগত দুর্বল করিয়া চলিয়াছে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করিয়া যে ভারত আপন বহুত্ববাদী উদারতার গৌরবে বিশ্বের দরবারে অভিবাদন কুড়াইয়াছিল, আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে তাহার নাম শুনা যায় শুধু গণতন্ত্রের বিভিন্ন সঙ্কটের সূত্রে, যথা রাষ্ট্রের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘন অথবা শাসকের নির্দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ। এই দুর্ভাগ্যের সাক্ষী এবং সূত্রধার এই শতবর্ষীয় সংবাদপত্র কেবল প্রার্থনা করিতে পারে: অন্ধকারই শেষ কথা নহে। রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকট’ ভাষণের উপসংহার স্মরণ করিয়া বিশ্বাস করিতে পারে যে, ‘প্রবলপ্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয়’ তাহাই ইতিহাসের সত্য।

আরও পড়ুন
Advertisement