প্রতীকী ছবি।
সফট স্টেট বা ‘শিথিল রাষ্ট্র’ অভিধাটির জনক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডাল এখন ইতিহাসের অঙ্গ। তাঁহার সুবিপুল এশিয়ান ড্রামা-ও আর বহুচর্চিত নহে। কিন্তু রাষ্ট্র যে কতখানি শিথিল হইতে পারে, তাহার অগণন নমুনা এই দেশে থরে থরে বিরাজমান। এই রাজ্যেও। শিথিল রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান লক্ষণ— সে আইন যত বানায় তাহা মানাইতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইন লঙ্ঘনের সংবাদ রচিত এবং উদ্ঘাটিত হইতেছে। যেমন, ২০১৭ সালের ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট আইন। এই আইনের একটি বিধান: যে সব বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের সময় সরকার সুলভে জমির ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছে বা অন্য ভাবে সাহায্য করিয়াছে সেখানে রোগীদের একটি ন্যূনতম নির্ধারিত অংশকে নিখরচায় চিকিৎসা দিতে হইবে। এই আইনের লক্ষ্য তথা যুক্তি সহজবোধ্য: চিকিৎসা সরবরাহের বাণিজ্য গড়িবার জন্য গৃহীত সরকারি সাহায্যের ‘মূল্য’ হিসাবে সেই বাণিজ্যের উদ্যোগীদের কিছুটা সামাজিক পরিষেবা দিতে হইবে। ব্যবস্থাটি বহুলপ্রচলিত। গোল বাধিয়াছে এই ব্যবস্থার প্রয়োগ লইয়া। অভিযোগ উঠিয়াছে, অনেক হাসপাতালই নির্ধারিত সামাজিক পরিষেবা দেয় নাই, নিখরচায় চিকিৎসার নিয়ম লঙ্ঘিত হইয়াছে। কিছু হাসপাতালের পরিচালকরা অভিযোগ অস্বীকার করিয়াছেন, কিছু বা নীরব। যাঁহারা অস্বীকার করিয়াছেন, তাঁহাদেরও একাংশের উত্তর যথেষ্ট সুস্পষ্ট নহে।
কিন্তু এই সব নীরবতা ও অস্পষ্টতাকে তুচ্ছ করিয়া দেয় একটি তথ্য— প্রায় দুই ডজন হাসপাতালকে জমির ব্যবস্থা করিয়া দিবার বিষয়ে সরকারি ফাইল স্বাস্থ্য ভবনে খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। অর্থাৎ, ঠিক কী শর্তে তাহাদের জমি দেওয়া হইয়াছিল তাহার নথি সরকারের হাতে নাই। এই অবস্থায় হাসপাতালগুলি কী শর্ত কতখানি লঙ্ঘন করিতেছে তাহাও নির্ণয় করা দুঃসাধ্য হইতে পারে। অনুমান করা যায় যে অতঃপর সামাজিক পরিষেবার ব্যাপারটি হাসপাতালের পরিচালকদের সদিচ্ছার উপরেই নির্ভর করিবে। ক্ষেত্রবিশেষে তাঁহাদের সদিচ্ছা জাগ্রত করিবার জন্য হয়তো নানা ভাবে সরকারি চাপ তৈয়ারি করা হইবে, যাহার সহিত আদি চুক্তি ও শর্তাবলির সম্পর্ক নাই। স্পষ্টতই, এমন সম্ভাবনার সহিত আইনের শাসনের কোনও সম্পর্ক নাই। সরকারি ফাইল কেন কী ভাবে উধাও হইয়া যায়, তাহা নিছক অবহেলার পরিণাম না গূঢ়তর কার্যকারণসূত্রের খেলা, যে কারণেই এমন বিরাট বিচ্যুতি ঘটিয়া থাকুক, সংশ্লিষ্ট অপরাধীকে চিহ্নিত করিয়া কেন শাস্তি দেওয়া হইবে না— এই সকল স্বাভাবিক এবং গুরুতর প্রশ্নের সদুত্তর মিলিবে, তাহার কিছুমাত্র ভরসা এই রাজ্যের নাগরিক করেন না, তাঁহারা শিথিল রাষ্ট্রকেই বিধিলিপি বলিয়া বরণ করিয়াছেন।
কিন্তু প্রশ্ন কেবল ফাইল হারাইবার নহে। বিভিন্ন উপলক্ষে বারংবার দেখা গিয়াছে, হাসপাতাল তৈয়ারির জন্য সরকারের নিকট কী সাহায্য লইলে বিনিময়ে কতটা সামাজিক পরিষেবা দিতে হইবে, তাহা লইয়া সর্বস্তরে বিপুল অস্বচ্ছতা, বিস্তর সংশয়। এই অস্বচ্ছতা কেবল সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত নহে, অর্থনীতি ও সমাজের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। সামাজিক পরিষেবায় বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজনীয়, তাহা আজ অবিসংবাদিত। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের জন্য সুস্পষ্ট শর্ত সম্বলিত যথাযথ চুক্তি করা না হইলে বিনিয়োগ আসিবে কেন? এই প্রাথমিক সত্যটি পূর্ববর্তী বামফ্রন্ট সরকারের চালকরাও বুঝিতেন না, তাঁহাদের উত্তরসূরিরাও যথেষ্ট বোঝেন বলিয়া প্রত্যয় হয় না। তাঁহারা আইন করিয়াছেন, মাঝে মাঝেই ধমকধামকও দিয়া থাকেন, কিন্তু বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপযোগী একটি সুস্থ আয়োজন গড়িতে পারেন নাই। বিশেষ বিশেষ ফাইল হারাইলে এই অপারগতা ধামাচাপা পড়িতে পারে, পরিষেবার স্বাস্থ্য ফিরিবে না।