Politics

দয়ার দান

এক দিকে, পরিকাঠামো উন্নয়নে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ক্রমহ্রাসমান হওয়ায় সেই উন্নতি ক্রমশ সাঙাততন্ত্রের স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৩৪
election.

—প্রতীকী ছবি।

শেষ অবধি প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভেসে গেল পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। সেই সব প্রতিশ্রুতি, প্রধানমন্ত্রী যাকে দাগিয়ে দিয়েছিলেন ‘রেউড়ি’ নামে। অবশ্য, পাঁচ রাজ্যে রেউড়ি বিলির প্রতিযোগিতায় তিনিই চ্যাম্পিয়ন কি না, তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। কিন্তু, তার চেয়েও বড় তর্ক, গণদেবতা কেন রেউড়ির নৈবেদ্যতেই সন্তুষ্ট? কেন মাসে পাঁচশো টাকা নগদ অথবা গ্যাস সিলিন্ডারে ভর্তুকির প্রতিশ্রুতি পেলেই ভোটারের মন গলে— নিদেনপক্ষে, গলে বলেই নেতাদের ধারণা? এই প্রশ্নের একটি উত্তর প্রবাদবাক্যে রয়েছে— ঝোপে থাকা দু’টির বদলে হাতে থাকা একটি পাখি শ্রেয়। সাধারণ মানুষ অভিজ্ঞতায় শিখেছেন, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের গালভরা প্রতিশ্রুতি আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, হলেও তার সুফল কার ভাগে কতখানি পড়বে, কিছুরই নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু হাতেগরম নগদের প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত হওয়ার সাহস নেতাদের সচরাচর হয় না। ফলে, অল্প হলেও সেই প্রতিশ্রুতিতেই লাভ। এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন— লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো নগদ হস্তান্তরের প্রকল্পের উন্নয়ন-ক্ষমতা অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই। প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের এই পথে হেঁটে বিকল্প উন্নয়ন-নীতি নির্মাণ করা সম্ভব কি না, সেটিও খোলা তর্ক। প্রশ্ন হল, সাধারণ মানুষ কি বিবিধ উন্নয়ন নীতির মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার করে তবেই নগদ হস্তান্তরের নীতিটিকে শ্রেয় বিবেচনা করেছেন? না কি, নেহাত সহজে কিছু টাকা পাওয়া যাচ্ছে বলে মানুষ রায় দিচ্ছেন এই পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির অনুকূলে; এবং সাধারণ মানুষ এটাই চায়, এই যুক্তিতে নেতারাও নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চ থেকে বিলিয়ে চলেছেন অনুগ্রহের মহাপ্রসাদ?

Advertisement

উত্তরটা জানা। এবং, সেই কারণেই তা গণতন্ত্রের ব্যর্থতার বার্তা বহন করে। সাধারণ মানুষ উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করেন না, কারণ সেই প্রতিশ্রুতি কতখানি পূরণ হল, কী ভাবে তা পূরণ করার কথা ভাবছে সরকার— এই প্রশ্নগুলি করার অধিকার তাঁদের আছে বলে মানুষ বিশ্বাস করেন না। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থক হিসাবে স্লোগান তুলে প্রশ্ন করার কথা নয়, কোনও রাজনৈতিক ছাতার তলায় না থাকা সাধারণ নাগরিকের পক্ষে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে উন্নয়নের খতিয়ান পেশ করার দাবি করা এ দেশে অসম্ভব। খাতায়-কলমে জনপ্রতিনিধিরা নাগরিকের কাছে জবাবদিহি করতে দায়বদ্ধ, কিন্তু আসলে এই রাজতন্ত্রে তাঁরা রাজাধিরাজ— তাঁদের প্রশ্ন করে, সাধারণ নাগরিকের সেই ক্ষমতা কোথায়? নেতাদের এই প্রশ্নহীন ক্ষমতা, এবং জনতার সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীনতা— এই ভারসাম্যহীনতাই দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের প্রশ্নকে পিছনের সারিতে ঠেলে দিয়েছে।

তার ফল বহুমুখী। এক দিকে, পরিকাঠামো উন্নয়নে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ক্রমহ্রাসমান হওয়ায় সেই উন্নতি ক্রমশ সাঙাততন্ত্রের স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। তাতে সার্বিক ভাবে ক্ষতি। অন্য দিকে, প্রাথমিক শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক মানবসম্পদ পরিকাঠামোর ক্ষেত্রেও যে-হেতু সরকারের প্রতি ভরসা কমেছে, এই ক্ষেত্রগুলিতেও ক্রমে বেসরকারি পুঁজির দখল বাড়ছে। এর অনিবার্য পরিণতি উন্নয়নের অসমতা, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক চলমানতার পথে তাৎপর্যপূর্ণ বাধা সৃষ্টি করতে পারে। ক্ষতির এখানেই শেষ নয়। উন্নয়নের খাতে রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের যা প্রাপ্য, তা যে নেতাদের খয়রাতি বা দয়ার দান নয়, নাগরিকের অধিকার, এই কথাটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ইউপিএ সরকার। খয়রাতির রাজনীতি নাগরিকের হাত থেকে সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছে— রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কটি আবারও দাঁড়িয়েছে দাতা ও গ্রহীতায়, রাজা এবং প্রজায়। গণতন্ত্রের পক্ষে তা অতীব দুঃসংবাদ, উন্নয়ন নীতির পক্ষেও। যে উন্নয়নে নাগরিকের অংশীদারি নেই, আগ্রহও নেই, তা শেষ অবধি সাঙাততন্ত্রের স্বার্থসিদ্ধির আয়ুধ বই আর কিছুই হয়ে উঠতে পারে না।

আরও পড়ুন
Advertisement