Education

চিন্তাহীন, তাই নিশ্চিন্ত

সম্প্রতি মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদরা এই রাজ্যের শিক্ষা-দুর্নীতি বিষয়ে কী মনে করেন, সেটা তাঁর জানতে কৌতূহল হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০৬:২৮
২০২১-এর তুলনায় শিশুদের লেখাপড়ার মানও কিছুটা বেড়েছে।

২০২১-এর তুলনায় শিশুদের লেখাপড়ার মানও কিছুটা বেড়েছে। প্রতীকী ছবি।

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রীর মতে, এই রাজ্যের স্কুলশিক্ষায় অতিমারির কালে যে ঘাটতি হয়েছে, তা ‘আমাদের সরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা দ্রুত মিটিয়ে দেবেন।’ এমন উচ্চাঙ্গের আশ্বাসবাণী শুনে প্রশ্ন জাগতেই পারে: হে ভরসা, তুমি কোথা হইতে আসিতেছ? রসিক জনে বলবেন: তাঁহার অনুপ্রেরণা হইতে। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্যই স্বভাবসিদ্ধ প্রাবল্যে সেই রসিকতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে জানাবেন, আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে— পশ্চিমবঙ্গ যে সারা দেশে শিক্ষায় এগিয়ে আছে, তা তো প্রমাণিত! ‘প্রথম’ নামক অসরকারি সংস্থাটির সমীক্ষা রিপোর্টে শিক্ষামন্ত্রী সেই প্রমাণ আবিষ্কার করেছেন। ‘আসের’ নামে পরিচিত শিক্ষা সম্পর্কিত এই বার্ষিক রিপোর্ট প্রায় দু’দশক ধরে প্রকাশ করে চলেছে সংস্থাটি। সদ্য প্রকাশিত ‘আসের ২০২২’ জানাচ্ছে, কোভিডকাল পেরিয়ে রাজ্যের সরকারি স্কুলে প্রাথমিক স্তরে ভর্তি বেড়েছে। ২০২১-এর তুলনায় শিশুদের লেখাপড়ার মানও কিছুটা বেড়েছে। সর্বভারতীয় মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি মন্দ নয়। অতএব, সরকার নিশ্চিন্ত। না ভাবলেই তো ভাবনা থাকে না, তবে আর মিছিমিছি ভাবনা কেন?

এই নিশ্চিন্ততা গভীর উদ্বেগ জাগায়। ভর্তির হার নিতান্তই স্কুলের খাতায় নাম থাকা-না-থাকার ব্যাপার। ক্লাসে উপস্থিতির হার এখনও মাত্র ৬৮ শতাংশ। আর, স্কুলে ভর্তি বা উপস্থিতি শিক্ষার প্রাথমিক শর্তমাত্র, শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া কেমন শিখছে সেটাই মূল প্রশ্ন। ‘প্রথম’-এর রিপোর্টে সেই প্রশ্নের যে সব উত্তর মিলেছে, তা কিছুমাত্র স্বস্তি দেয় না। যেমন, এ রাজ্যে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের দুই-তৃতীয়াংশ দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই স্বচ্ছন্দ ভাবে পড়তে পারে না। পাটিগণিতেও তথৈবচ। অন্যান্য শ্রেণির পরিসংখ্যানও অনুরূপ চিন্তার কারণ। সমীক্ষার দিন অনুপস্থিত এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে এই অনুপাতগুলি আরও কম হওয়াই প্রত্যাশিত; সুতরাং, প্রকৃত চিত্র সমীক্ষার পরিসংখ্যানের থেকেও মলিন। সত্য এই যে, অতিমারির আগেও পড়াশোনার মান সন্তোষজনক ছিল না, এখন তা আরও অনেক নেমেছে। বিশেষত যে শিশুরা এখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে, তারা দু’বছর কার্যত কিছুই শেখেনি। কিছু পরিসংখ্যান সঙ্কেত দেয় যে, রাজ্যে শিশুদের লেখাপড়ার হাল এক দশক আগেকার অবস্থায় পিছিয়ে গিয়েছে। স্পষ্টতই, পরিস্থিতি শোধরানোর জন্য প্রয়োজন সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। সেই কাজে সরকারের নেতৃত্ব এবং সক্রিয়তা অত্যাবশ্যক, বিশেষত এই রাজ্যে, কারণ এখানে শিশুদের সরকারি স্কুলে যাওয়ার অনুপাত বেশি, আবার গৃহশিক্ষক (তথা কোচিং ক্লাস)-এর উপর নির্ভরতাও বেশি। অর্থাৎ, অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে সন্তানকে সরকারি স্কুলে পাঠাচ্ছেন, কিন্তু সেখানে লেখাপড়া ঠিকমতো হয় না বলে বাজারে শিক্ষা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশের মধ্যে ‘এগিয়ে থাকা’র প্রকৃত অর্থ একটাই— অনেক রাজ্যের হাল আরও খারাপ। সেই গৌরবেই কি রাজ্য সরকার গর্বিত?

Advertisement

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদরা এই রাজ্যের শিক্ষা-দুর্নীতি বিষয়ে কী মনে করেন, সেটা তাঁর জানতে কৌতূহল হয়। কৌতূহল কেন বাধ্যতে? তবে কিনা, নোবেলজয়ীরা— এবং অন্য শিক্ষাবিদরাও— দীর্ঘ দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার গুণমানের অবনতি নিয়ে দুশ্চিন্তিত ও সরব। অমর্ত্য সেন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে তৎপর হতে বলে এসেছেন। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘প্রথম’-এর রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষেও শিক্ষার মান কী ভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। পণ্ডিতরা শিক্ষার মৌলিক সমস্যা মোকাবিলার জন্য যে পরামর্শ দিয়ে আসছেন, শাসকরা তাতে কেন কান দেন না, শিক্ষানুরাগী নাগরিক যদি সে-কথা জানতে কৌতূহলী হন, সেই জিজ্ঞাসাও বোধ করি অসঙ্গত নয়।

আরও পড়ুন
Advertisement