Sandeshkhali Incident

বিভেদকামী

গত বছরই এক নির্দেশে সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছিল, ঘৃণা ভাষণ গুরুতর অপরাধ। এতে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোয় আঘাত লাগে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৫৬
sandeshkhali

— ফাইল চিত্র।

একটিমাত্র শব্দে কী ভাবে এক জনকে ‘অপর’ করে দেওয়া যায়, তাঁর জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ পরিচয় তুলে প্রকারান্তরে দেখিয়ে দেওয়া যায় যে তিনি মূলস্রোতের বাইরে, তদর্থে গ্রহণীয় নন, সেই অভ্যাসটি ইদানীং কালে ভালই রপ্ত করেছেন ভারতের রাজনৈতিক নেতারা। ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘সন্ত্রাসবাদী’, ‘ভারতবিরোধী’র মতো শব্দগুলি তাই জনসভায়, আলোচনায়, পারস্পরিক সম্বোধনে অধুনা বহুল ব্যবহৃত। যেখানেই মতের অমিল, ভাবাদর্শের সংঘাত, সেখানেই এই বিভাজনের রাজনীতি তুরুপের তাস। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে সন্দেশখালি যাওয়ার পথে বাধা পেয়ে কর্তব্যরত আইপিএস অফিসারের উদ্দেশে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল থেকে যে ‘খলিস্তানি’ মন্তব্য শোনা গিয়েছে, তাতে হয়তো বিস্ময় বোধ হয় না। কারণ, দীর্ঘলালিত ঘৃণার রাজনীতির ফসল এই মন্তব্য, যে রাজনীতি শিখিয়েছে পাগড়ি-পরিহিত সকল শিখকে ‘খলিস্তানি’ ভাবতে, মুসলিম মাত্রেই পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ‘সুপরামর্শ’ দিতে। এটাও শিখিয়েছে, এক-একটি গোষ্ঠী পরিচয়ের মধ্যে যে বিভিন্ন স্তর থাকে, ভিন্ন ভাবনা, মতাদর্শগত পার্থক্য থাকে— সেগুলিকে অগ্রাহ্য করতে। ফলে, একটি অপ্রীতিকর ঘটনা, একটি রক্তাক্ত অতীত টেনে এনে যে সেই পরিচয়ের সকলের মাথায় একই ছাপ দেওয়া চলে না, সেই স্বাভাবিক বোধ লুপ্ত হয়ে পড়ে থাকছে এক স্থূল বিভেদকামী মানসিকতা। এই ভারত বিপন্ন বইকি।

Advertisement

অথচ, গত বছরই এক নির্দেশে সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছিল, ঘৃণা ভাষণ গুরুতর অপরাধ। এতে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোয় আঘাত লাগে। ঘৃণা ভাষণ রুখতে একগুচ্ছ নির্দেশিকাও জারি করা হয়েছিল। তৎসত্ত্বেও সেই প্রবণতা বন্ধ হয়নি। বিভেদমূলক রাজনীতি জিইয়ে রাখতে বিজেপির ধারাবাহিকতা অনন্য হলেও এই রাজনীতির চর্চা অল্পবিস্তর সমস্ত দলই করে চলে। সুতরাং একে নির্মূল করতে সদিচ্ছার অভাবটি লক্ষণীয়। ঘৃণা ছড়াতে সর্বদা ভাষণের প্রয়োজন পড়ে না, টুকরো মন্তব্য, বিদ্রুপ, তাচ্ছিল্যের অভিঘাতও এতই তীব্র হয় যে, তা স্থান-কালের সীমানা অতিক্রম করে আগুন জ্বালাতে সময় নেয় না। এ ক্ষেত্রে যেমন এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিমধ্যেই পথে নেমেছে পাঁচটি শিখ সংগঠন। ‘মাথার পাগড়ি নিয়ে সস্তা ও বৈষম্যের রাজনীতি’র প্রসঙ্গ তুলে উপযুক্ত তদন্তেরও দাবি জানানো হয়েছে। রাজ্যপাল বিবৃতি দিয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় সুরক্ষায় শিখদের অবদানের কথা মনে করিয়েছেন।

তবে বিভেদ সৃষ্টির দায় সম্পূর্ণ রাজনীতির, তা অসত্য বচন। নাগরিকের নিজেকেও প্রশ্ন করতে হবে, তাঁরা কি এরই শরিক নন? রাজনৈতিক নেতারা কি সেটাই উচ্চারণ করেন না, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ শুনতে পছন্দ করেন? বাস্তব হল, নাগরিক সমাজের বৃহৎ অংশ তাঁদের দৈনন্দিনতায় পারস্পরিক ঘৃণার বীজটি সযত্নে লুকিয়ে রাখেন। খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, পরিধান নিয়ে ঠাট্টা, সমালোচনার আড়ালে সেই বিদ্বেষবিষকে প্রতিনিয়ত লালন করেন। মুসলমান পরিবার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে ঘর ভাড়া পান না, ভিন্ন জাতে-ধর্মে বিবাহ করলে খুন হন দম্পতি, ‘খেলায় উত্তেজনা’র নামে পাশে-বসা মানুষটিকে পড়শি দেশে চলে যাওয়ার নিদান দেওয়া হয়। ঘৃণার এই রংটি বহুপরিচিত, সমগ্র ভারতকে তা গ্রাস করার পথে।

আরও পড়ুন
Advertisement