Couple Beaten In Karnataka

সত্য সে সনাতন

নাগরিকের নিজের জীবন, কর্ম ও পছন্দ বেছে নেওয়ার অধিকার যে এই দেশ তার সংবিধান মারফত নাগরিকদের সসম্মানে হাতে তুলে দিয়েছে, এই মানুষগুলি তা বুঝতে চান না। ধর্ম আলাদা হলে তো বোঝার প্রশ্নই নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:২৯
An image of beating

—প্রতীকী চিত্র।

ঘটনাটি ঘটেছে কর্নাটকে। তবে দেশের অন্য কোনও রাজ্যেও ঘটতে পারত, এই সময়ে দাঁড়িয়ে অসম্ভব কিছু ছিল না তা। অটোয় চড়ে হোটেলের ঘরে ঢুকলেন এক পুরুষ ও এক মহিলা, মহিলার পোশাক দেখে অটোচালক বুঝতে পারলেন তিনি ‘ভিন্ন ধর্ম’-এর। তাঁর কাছে খবর পেয়ে অচিরেই স্থানীয় যুবকেরা এসে চড়াও হলেন হোটেলে, দু’জনকেই গালাগালি মারধর করলেন, দীর্ঘ হেনস্থার পর মহিলার হাতে টাকা দিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন বাড়ির ঠিকানায়। বোঝাই যাচ্ছে, এ আরও একটি নীতিপুলিশির ঘটনা। প্রাপ্তবয়স্ক দুই ভিন্নধর্মী নরনারী যদি সজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় নিভৃতে সময় কাটাতে চান, এই অটোচালক, যুবকের দল এবং তাঁদেরই মতো বহু ভারতীয় তা বন্ধ করতে উঠেপড়ে লাগবেন, কারণ এ কাজ তাঁদের মতে নীতিবিরুদ্ধ, অনৈতিক, অবৈধ। প্রাপ্তবয়স্কের এই অধিকার, নাগরিকের নিজের জীবন, কর্ম ও পছন্দ বেছে নেওয়ার অধিকার যে এই দেশ তার সংবিধান মারফত নাগরিকদের সসম্মানে হাতে তুলে দিয়েছে, এই মানুষগুলি তা বুঝতে চান না। ধর্ম আলাদা হলে তো বোঝার প্রশ্নই নেই। এঁরা এক ভিন্ন নীতি ও নৈতিকতার বোধে তাড়িত ও চালিত— এঁদের মুখে তা অহরহ শোনাও যায়: এটি ভারতীয় সংস্কৃতি নয়, ওটি ‘সনাতন’ ভারতের নৈতিকতা নয়।

Advertisement

ঠিক কোনটি ‘ভারতীয়’ এবং ‘সনাতন’, এঁরা নিজেরাও কি জানেন! তাঁরা নিজেদের শর্তে, নিজেদের স্বার্থে তৈরি করেছেন সংজ্ঞা: ভারতীয় ও সনাতন মানে বিধর্মী ও বেজাতের থেকে দূরত্ব বজায়, বিশুদ্ধতা রক্ষা। এ এক বিশেষ ভাবে দেখা: তার ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত বিচার পরের কথা, তবে এ নিয়ে সংশয় থাকতে পারে না যে সনাতন ভারতীয়কে বোঝানোর এটি একটি, এবং অনেকের মধ্যে একটি ব্যাখ্যা— একমাত্র ব্যাখ্যা নয়। আরও একটি ব্যাখ্যাও প্রাচীন ও প্রচলিত, যা বলে: বহুত্বের মধ্যে একত্বই হল ভারতীয়ত্ব, বিবিধের মাঝে মিলনই হল তার সনাতন সুর। রবীন্দ্রনাথ যখন ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় লেখেন, “হেথায় আর্য হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড় চীন—/ শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।...” তা নানা দেশ জাতি সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষের এই ভূমিতে এসে একত্রবাসের কথা বলে। এই সম্মিলন সহ-বাস ও সহবাস দুই-ই, সমান ভাবে। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ হয়ে প্রাগাধুনিক ও আধুনিক কালেও, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বিপুলসংখ্যক ভারতীয়ের কাছে তা শুধু বিশ্বাসের নয়, আচরণ ও যাপনেরও সত্য। এত কাল ধরে যা এই ভারতভূমিতে চলে এসেছে ও আসছে সে তো ভারতীয় বটেই, এ-ও কি ‘সনাতন’ নয়? ভারতের ইতিহাস আলোকপ্রাপ্তির ইতিহাসও, উনিশ শতক ইস্তক রামমোহন বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ আদি মনীষীরা যে আধুনিকতায় স্থিত করে গিয়েছেন দেশকে, সেখানে এই ‘বহুর মিলন’-এর বার্তাটিই প্রোজ্জ্বল— এমনকি সেই পরজাতি-পরধর্মশাসিত কালেও। স্বাধীন ভারতের রূপকাররা এই ‘সনাতন’ পরম্পরা সূত্রেই চেয়েছিলেন আধুনিক ভারত হবে জাতি-বর্ণ-ধর্মের ঊর্ধ্বে ওঠা এক দেশ, ভারতরাষ্ট্রের সংবিধানটিও লেখা হয়েছিল সেই বিশ্বাস ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকেই।

এই আবহমান আলোকিত সনাতনকে দমিয়ে দিতে চাইছে সঙ্কীর্ণ একটেরে সনাতন, এমনটা দেখা যাচ্ছে ঘন ঘন। ভিন্ন ধর্ম নিয়ে সহিষ্ণুতা ও উদারতার সমান্তরালে ছুতমার্গও কম-বেশি সব সময়েই ছিল, কিন্তু এই বোধটিও ছিল যে, দুই ধর্মের মেলামেশা ঘনিষ্ঠতা আমার অপছন্দের হলেও সহ-নাগরিকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের সহবত শেখানো যায় না; মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে মর্যাদা দেওয়াটাই আসলে সহবত। গত দশ বছরে যে এই বোধটি ক্রমক্ষীয়মাণ হয়ে পড়ছে, তার প্রমাণ হরিয়ানা থেকে কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশ থেকে কেরলে স্বঘোষিত নীতিপুলিশদের নিয়মিত তর্জনগর্জন। কেন্দ্রে শাসক দলের নৈতিক ও রাজনৈতিক ছত্রছায়াতেই যে এদের এই বাড়বাড়ন্ত, বলার অপেক্ষা রাখে না। ভিন ধর্ম ও ধর্মীদের ভ্রুকুটিকুটিল চোখে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটি সেই দলনেতাদেরই প্রত্যক্ষ অবদান, ‘লাভ জেহাদ’ শব্দবন্ধও তাঁদের সৃষ্টি। এঁরাই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন কী ভাবে বিধর্মীর স্পর্শ ও প্রভাব থেকে স্ব-ধর্মের শুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে, এবং সেই কাজে ভীতি-প্রদর্শন, হিংসা, রক্তপাত কোনও কিছুই অ-নৈতিক নয়। কর্নাটকে যে যুবকেরা হোটেলের ঘরে পুরুষ ও মহিলাটির উপরে চড়াও হয়েছিলেন, তাঁরা কোনও দল বা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। অথচ এঁদের মনে হয়েছে, যে কাজ তাঁরা করছেন, ঠিক করছেন। নিজেদের অজানতেই এক হিংস্র সনাতনের রক্ষক হয়ে উঠলেন তাঁরা, এটাই সেই সঙ্কীর্ণ রাজনীতির জয়।

আরও পড়ুন
Advertisement