Amartya Sen

যুক্তসাধনার সূত্র

ক্ষিতিমোহনের সূত্র ধরেই অমর্ত্য সেন এ ক্ষেত্রে জোর দেন ‘সহকাজ’-এর উপর। বিভিন্নতা ও বৈচিত্রকে স্বীকার করেই সহকাজে সম্মিলিত হওয়া প্রয়োজন।

Advertisement
         
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:০৯
অমর্ত্য সেন।

অমর্ত্য সেন। ফাইল ছবি।

যুক্তসাধনা: বৈচিত্রের মধ্যে সমন্বয়— এই বিষয়ে সম্প্রতি একটি আলোচনাসভার আয়োজন হয়েছিল কলকাতায়। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন উপাচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা গ্রন্থের সূত্র ধরে এই বিষয় নির্বাচন। এই বিষয়ে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের নানা প্রশ্ন নিয়ে সভায় আলোচনা করেছেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। ভারতের সংস্কৃতিতে বৈচিত্রের গুরুত্ব বহু-আলোচিত, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য তথা সমন্বয় সন্ধানের ধারণাটিও সুবিদিত। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর কবিতায় শক-হুন-পাঠান-মোগল এক দেহে লীন হওয়ার কথা লেখেন, তখন তা নিতান্ত কবি-কল্পনা নয়, তার মধ্যে নিহিত থাকে ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু এই সমন্বয় একটি বহুমাত্রিক ধারণা, ‘এক দেহে লীন’ হলেও বৈচিত্রের অভিজ্ঞানগুলি কবির ভারততীর্থে মুছে যায় না। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য মানে যে আসলে বৈচিত্র নিয়ে ঐক্য, এই কথাটি ভুলে গেলেই বিপদ, যে বিপদের নাম একাধিপত্য, অর্থাৎ ক্ষমতাহীন অনেকের উপর ক্ষমতাশালী একের আধিপত্য। ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে হিন্দুত্ববাদীরা যখন গৌরবময় হিন্দু-অতীতের নির্ভেজাল কল্পনায় মত্ত হয়ে তার একমাত্রিক রূপায়ণ ঘটাতে বদ্ধপরিকর, তখন বৈচিত্রের মধ্যে সমন্বয়ের মূল্য স্বভাবতই অপরিসীম।

এবং এখানেই যুক্তসাধনার বিশেষ গুরুত্ব। বিভিন্ন ধারার, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ নিজের নিজের স্বকীয়তা নিয়েই পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় খুঁজবেন, যৌথ জীবনের অনুশীলন করবেন— এই ধারার কথাই ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছেন তাঁর গভীর অধ্যয়ন ও পরিশ্রমী অনুসন্ধানের ভিত্তিতে। তিনি দেখিয়েছেন, ভারতে প্রাগাধুনিক পর্বে যেমন সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্তরে সাহিত্যে শিল্পকলায় ভাস্কর্যে সঙ্গীতে এই সমন্বয় মূর্ত হয়েছিল, তেমনই প্রশাসনিক স্তরেও এর প্রভাব পড়েছিল, মুসলমান শাসকদের দরবারে হিন্দু অভিজাতরা স্থান পেয়েছিলেন। এ নিছক সহনশীলতার আদর্শ নয়, যুক্তকর্মের আদর্শ। ক্ষিতিমোহন তাঁর এই যুক্তসাধনার ভাবনার সমর্থন পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ কেবল ক্ষিতিমোহনের ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা বইটির ভূমিকাই লিখে দেননি, তাঁর নিজের ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ নামক প্রবন্ধে এই বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, ক্ষিতিমোহন বা বিধুশেখর শাস্ত্রীর শান্তিনিকেতনের সাধনাও ছিল এই ধারার অনুসারী।

Advertisement

ক্ষিতিমোহনের সূত্র ধরেই অমর্ত্য সেন এ ক্ষেত্রে জোর দেন ‘সহকাজ’-এর উপর। বিভিন্নতা ও বৈচিত্রকে স্বীকার করেই সহকাজে সম্মিলিত হওয়া প্রয়োজন। অমর্ত্য সেন তাঁর আলোচনায় ‘বৈচিত্র’ শব্দটিতে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছেন। তাঁর মতে, বৈচিত্রের স্বরূপ বিচার করা দরকার। যে বৈচিত্র ভেদ-পার্থক্য-অসামঞ্জস্যের সূচক তা নেতিবাচক। তাঁর ভাবনাকে সম্প্রসারিত করে বলা চলে, ধরা যাক অত্যন্ত ধনশালী এক ব্যক্তি তাঁর সুবিশাল হর্ম্যটিকে দীনের কুটিরের পাশে প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর উদ্দেশ্য সম্পদের অহমিকা প্রদর্শন। ধনীর কুটির ও দীনের কুটির পাশাপাশি আছে। ধনী ব্যক্তিটি তাঁর পক্ষে যুক্তিসজ্জার জন্য বলতে পারেন, এ-ও তো বৈচিত্রের প্রকাশ— সম্পদের বৈচিত্র। সন্দেহ নেই এ নিতান্ত অপযুক্তি। যে বৈচিত্র সামাজিক ভেদ ও বৈষম্যের রূপ, তা প্রকৃতপক্ষে বৈচিত্র নয়, সামাজিক অসামঞ্জস্যের প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ এ জন্যই সম্পদের সামাজিক দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। যুক্তসাধনায় রত হওয়ার জন্য এই বিভেদমূলক বৈচিত্রকে অস্বীকার করতে হবে। যে ভেদ-চিহ্ন প্রতি মুহূর্তে অপরকে লাঞ্ছিত করে তার অবসান আবশ্যিক, কারণ তা অনৈতিক, ঐক্যের পথে অন্তরায়। লক্ষ করা দরকার, এই নেতিবাচক বৈচিত্রকেও কিন্তু যুক্তসাধনার পথেই মুছে ফেলা সম্ভব। তার পথটি সহজবোধ্য। যথার্থ যুক্তসাধনায় একে অপরের নিকটবর্তী হবেন। একে অপরকে জানবেন। পারস্পরিক সৌহার্দ স্থাপিত হলে, তখন কিন্তু নিজের স্বাধিকার প্রদর্শনের প্রমত্ততা থেকে মুক্তি ঘটবে। একের সঙ্গে অপরের হার্দিক যোগ সাধন হলে কখনও এক জন অপর জনকে তাঁর বৈশিষ্ট্যের উগ্র ঘোষণায় আঘাত করবেন না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘যেখানে যথার্থ পার্থক্য আছে সেখানে সেই পার্থক্যকে যথাযোগ্য স্থানে বিন্যস্ত’ করে ‘সংযত’ করে ‘তবে’ তাকে ‘ঐক্যদান করা সম্ভব’। এই সংযত শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ। ইতিবাচক বৈচিত্র সংযমের উপর স্থাপিত, যুক্তসাধনাও সংযম ও সামর্থ্যের যথাযথ বিন্যাসের উপর নির্ভরশীল। অমর্ত্য সেন তার একটি সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement