বানানা রিপাবলিক একটি দেশের নাম থেকে একটি রাজনৈতিক শব্দবন্ধে উত্তীর্ণ হয়েছে, ভারতীয় গণতন্ত্রের অবমাননায় যা এখন অহরহ উচ্চারিত। আবারও কথাটি শোনা গেল তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী, অসম থেকে রাজ্যসভার সাংসদ, সুস্মিতা দেবের মুখে। অসমের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর এই তীব্র ভর্ৎসনাময় মন্তব্য অতি সঙ্গত। সে রাজ্যে বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা ঘোষণা করেছেন যে রাজ্যের কোনও অধিবাসী আধার কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারবেন না, যদি না তাঁর এনআরসি তালিকায় নাম তোলা থাকে। ওই তালিকায় নাম তুললে যে রসিদ নম্বর বা এআরএন মেলে, সেটি আধারের আবেদনে লেখা আবশ্যক হল এখন থেকে। এই পন্থায় তাঁর সরকার সে রাজ্যে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে উদ্যোগী। অর্থাৎ, ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজ়েনস বা এনআরসি-তে নাম ওঠানো থাকলে তবেই কোনও ব্যক্তির পরিচয় ও ঠিকানা সরকারি ভাবে গ্রাহ্য হবে। বিবিধ দিক থেকে এই নতুন সংস্কার ভয়ানক, এবং রাজ্যবাসীকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে সমর্থ। এই একটি সংস্কারই বুঝিয়ে দেয় যে, কেবল বানানা রিপাবলিকের যদৃচ্ছ স্বৈরাচার নয়, মানুষকে জাত-ধর্ম ভিত্তিক ভাবে নির্যাতনের জন্য ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের সমস্ত লক্ষণ হিমন্তবিশ্ব শর্মার রাজনীতিতে উপস্থিত।
প্রথমত, এখনও অবধি রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয়া দ্বারা এনআরসি-কে এ বিষয়ে সম্মতি দেয়নি, অথচ তাতে এত বড় একটি পদ্ধতি চালু করা আটকাল না। দ্বিতীয়ত, এত দিন পর্যন্ত নাগরিক না হলেও আধার কার্ড পাওয়ার ব্যবস্থা ভারতীয় সরকারের নিয়মমতেই স্বীকৃত ছিল, বলা হয়েছিল যে ভারতে আধার কার্ডের আবেদনের আগের এক বছরে ১৮২ দিন এ দেশে থাকার প্রমাণ দেখালেই আধার আবেদনের যোগ্য হওয়া যাবে। তৃতীয়ত, যে-হেতু এনআরসি-তে যাঁদের নাম ওঠেনি, সকলকেই অনাগরিক বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না, তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্র আলাদা করে ট্রাইবুনাল বিবেচনাধীন— সে ক্ষেত্রে ভারত সরকার কোন যুক্তিতে এনআরসি তালিকা-বহির্ভূত মানুষদের আধার দিতে অস্বীকার করতে পারে? যাঁরা নাগরিক হতেই পারেন, কিন্তু কোনও তথ্য-সংক্রান্ত জটিলতায় এনআরসি-তে নাম নথিভুক্ত করতে পারেননি, তাঁরা এর পর থেকে আধারও পাবেন না? এবং আধার-নির্ভর সমস্ত রকম সরকারি প্রাপ্য, এমনকি বেসরকারি পরিষেবা থেকেও বঞ্চিত হবেন? বানানা রিপাবলিক ঠিক কেমন না জানলেও, মগের মুলুক বলে এই ব্যবস্থাকে সহজেই চিনে নিতে পারবে ভারতীয় সমাজ।
অথচ এই বিজেপি সরকারই কিন্তু একাধিক বার আশ্বাস দিয়েছিল যে কোনও একটি পরিচয়কে বাধ্যতামূলক করে তুলে নাগরিককে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা যাবে না। তার চেয়েও বড় কথা, সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালেই জানিয়ে দেয় যে আধারকে কখনওই আবশ্যক করে তোলা যাবে না নাগরিকের জন্য। অনুপ্রবেশ সমস্যা নিশ্চয়ই আকারে প্রকারে বিরাট। এমনকি বয়স প্রমাণেও আধার তথ্যকে প্রামাণ্য ধরা যাবে না, দেড় মাস আগে সুপ্রিম কোর্টের রায়। যে আধারের গুরুত্বকে এই ভাবে হ্রাস করা হচ্ছে, তার জন্য নাগরিকপঞ্জিতে নাম তোলা আবশ্যক কেন করতে হবে? রাজ্যে বেআইনি অনুপ্রবেশ ঠেকানোর নামে মুসলিম-নিয়ন্ত্রণের জন্য এখন সমগ্র সমাজের হাতে-পায়ে শৃঙ্খল পরানো হবে?