Partition of Bengal

বঙ্গভঙ্গ আর নয়

বঞ্চনাবোধের প্রতিকার অবশ্যই করা দরকার। সেই বোধ যে বাস্তব থেকে উঠে আসে, তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৬:২২
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ। — ফাইল চিত্র।

বিধানসভায় রাজ্য ভাগের বিরোধিতায় সরকার পক্ষের আনা প্রস্তাব-বিষয়ক আলোচনায় বিজেপির রাজ্য নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, তাঁর দল পশ্চিমবঙ্গকে ভাগ করার বিরোধী, তবে উত্তরবঙ্গ, সুন্দরবন, জঙ্গলমহলের মতো অঞ্চলের বঞ্চনা ও ক্ষোভের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। কথাটি এ ভাবেও বলা যেত যে, বিভিন্ন অঞ্চলের বঞ্চনাবোধের প্রতিকারে মনোযোগ জরুরি, কিন্তু রাজ্য ভাগ করার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। অনুমান করা যায়, শ্রীঅধিকারী যখন শাসক শিবিরে ছিলেন তখন এই ভাবেই বলতেন; কিন্তু এখন তিনি বিরোধী শিবিরে, অতএব ওই ভাবে বলেছেন। তাঁর দল উত্তরবঙ্গের রাজনীতিতে বিশেষ সাফল্য পেয়েছে, আরও সাফল্য পেতে চায়, অতএব অঙ্ক কষে কথার ঝোঁকটি উল্টে নিলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বলা বাহুল্য, এমন অঙ্ক কেবল অনৈতিক নয়, বিপজ্জনক। সেই বিপদের মাত্রা আরও প্রবল হয়, যখন বিজেপির কোনও কোনও বিধায়কের মুখে রাজ্য ভাগের প্রস্তাবে পরোক্ষ সমর্থনের সুর ধ্বনিত হয়। উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে স্বাতন্ত্র্যের দাবি অনেক দিন ধরেই শোনা গিয়েছে, তাকে কেন্দ্র করে সংগঠিত রাজনৈতিক কার্যকলাপও দেখা গিয়েছে। অধুনা সেই কার্যকলাপে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে রাজ্য বিজেপির একাংশের তৎপরতা। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিধানসভায় বিভাজন-বিরোধী প্রস্তাবটি আনা হয়েছে। বস্তুত, এমন প্রস্তাব যে আদৌ আনতে হয়েছে, সেটাই দেশভাগ-সঞ্জাত এই রাজ্যের পক্ষে রীতিমতো উদ্বেগের কারণ। কেবল শাসক দল নয়, এই কথাটি সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজ্যবাসীর সুস্পষ্ট ভাষায়— এবং কোনও কৌশলের অঙ্ক না কষে— ঘোষণা করা কর্তব্য যে, পশ্চিমবঙ্গের অখণ্ডতা ও সংহতির প্রশ্নে বিন্দুমাত্র আপস চলতে পারে না। বঙ্গভঙ্গ আর নয়।

বঞ্চনাবোধের প্রতিকার অবশ্যই করা দরকার। সেই বোধ যে বাস্তব থেকে উঠে আসে, তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আজ নয়, কার্যত এই রাজ্যের জন্মকাল থেকেই উত্তরবঙ্গের সমস্যা বিস্তর। ভূগোল সেই সমস্যার অন্যতম উৎস, কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইতিহাস— সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দূরত্বের দীর্ঘ ইতিহাস। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পরিসরে উত্তরবঙ্গ তার প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তাকে নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে— ওই অঞ্চলের মানুষের এই অভিযোগকে অহেতুক মনে করা যায় না। সম্প্রতি এই বৈষম্যের মাত্রা কিছুটা কমানোর চেষ্টা হয়েছে, অন্ততপক্ষে উত্তরবঙ্গের ব্যাপারে রাজ্য সরকারের মনোযোগ ও সক্রিয়তা অতীতের তুলনায় বেড়েছে। অবশ্যই তা যথেষ্ট নয়, দীর্ঘ দিনের বৈষম্য ও অবহেলার প্রতিকারে আরও অনেক বেশি উদ্যোগ জরুরি।

Advertisement

কিন্তু বিভাজন নয়, তার জন্য আবশ্যক যথার্থ সংহতি। সেই সংহতি উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এককেন্দ্রিক আধিপত্য নয়, অধিকারের বিকেন্দ্রীকরণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক সংহতি। বিজেপির পক্ষে সেই সংহতির মর্ম বোঝাও বোধ করি অসম্ভব, তাদের অভিধানে সংহতি এবং একাধিপত্য সমার্থক। দুঃখের কথা, রাজ্যের শাসকরাও বিকেন্দ্রীকরণের ভিত্তিতে বিভিন্ন অঞ্চলের গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ও সার্বিক সমৃদ্ধির প্রকৃত মূল্য যথেষ্ট বোঝেন বা বুঝতে চান বলে মনে হয় না। অনগ্রসর এলাকায় সরকারি মনোযোগ বা তৎপরতা প্রধানত প্রশাসন তথা দলের সর্বোচ্চ স্তরের নির্দেশ বা অনুপ্রেরণার উপরেই নির্ভর করে এবং তার দ্বারাই চালিত হয়। এই মাথাভারী রাজনীতির মৌলিক সংস্কার সাধন করে উত্তরবঙ্গের মতো অঞ্চলগুলিতে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের প্রসার ঘটাতে পারলে বিভাজনের কুরাজনীতির মোকাবিলা সহজতর হবে, উত্তরবঙ্গের কল্যাণের মধ্য দিয়েই গোটা রাজ্যের কল্যাণ সাধিত হবে।

আরও পড়ুন
Advertisement