New Parliament Building

কোন ভারতের নেতা

নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের দিন হিসাবে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের জন্মদিবসটিকে নির্বাচন করতেই আবার মোদী জনপরিসরের আলাপ-আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০২৩ ০৪:৪১
An image of New Parliament Building

নতুন সংসদ ভবন। ফাইল চিত্র।

নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের দিন হিসাবে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের জন্মদিবসটিকে নির্বাচন করতেই আবার তিনি জনপরিসরের আলাপ-আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার অবশ্য অন্য একটি যুক্তিতেও এই বছর জুড়ে সাভারকর-উদ্‌যাপন চালিয়ে যেতে পারে— কেননা ২০২৩ সালে একটি বইয়ের শতবর্ষ পূর্তি হচ্ছে, যেটিকে বলা যেতে পারে হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং ভারতীয় জনতা পার্টির দৃষ্টিতে বাইবেল-সম মান্যগ্রন্থ। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত সাভারকরের হিন্দুত্ব বইটি হিন্দুধর্ম আর হিন্দুত্ববাদের পার্থক্য সূচিত করে একটি রাজনৈতিক প্রকল্পের সূচনা করেছিল। এর আগেও অনেকেই হিন্দুদেশ-আদর্শ তৈরি করার কথা ভেবেছেন বা বলেছেন, গীতা অনুসরণ করে সহিংস আন্দোলনের দিকে এগিয়েছেন। মনে পড়তে পারে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের নাম, যিনি ছিলেন বাংলায় স্বদেশি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, এক সময় রবীন্দ্রনাথের বিশেষ প্রীতিভাজন— এবং পরবর্তী কালে গোরা ও ঘরে বাইরে দু’টি উপন্যাসেই যাঁর সঙ্গে কাল্পনিক আদর্শ-দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘মহামানবের সাগরতীরে’ ভারতবীক্ষা নির্মাণ। প্রসঙ্গত, সাভারকরের জাতীয়তাবাদী জীবনের প্রথম পর্বটিতে কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দুত্ব প্রকল্পের উপস্থিতি সে ভাবে ছিল না। প্রথম জীবনে ঘোর নাস্তিক সাভারকর ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লব আন্দোলনে জড়িত ছিলেন, সহিংস রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। উল্লেখ্য, বালগঙ্গাধর তিলকরা মহারাষ্ট্রে, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়রা বাংলায় যখন ‘হিন্দু ভারত’কে গৌরবান্বিত করছেন তাঁদের জাতীয়তাবাদী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে, সেই সময় সাভারকর কিন্তু তাঁর লেখা বইতে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম জাতীয় সংগ্রাম বলে দাবি করছেন। পরবর্তী কালে যে ‘পূণ্যভূ’ ভারতের কল্পনা থেকে তিনি মুসলমান বা খ্রিস্টানদের সটান বাদ দিয়ে দেবেন, এই বইতে তার কোনও ইশারা ছিল না, বরং হিন্দু-মুসলমান মিলিত বিদ্রোহ বিষয়ে আবেগ-যুক্তির সমন্বয়ে এক জোরালো পর্যালোচনা ছিল। এই সাভারকরই পরবর্তী কালে হিন্দুত্ব-পুরুষ স্বরূপে অবতীর্ণ হলেন। ১৯২৩ সালে হিন্দুত্ব পুস্তিকার প্রকাশ এবং ১৯২৪ সালে আন্দামানের জেল থেকে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি, এই দুই ঘটনা দিয়ে শুরু হল তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পর্ব।

এই দ্বিতীয় পর্বে তাঁকে আর এক বারও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকায় দেখা যাবে না, বরং ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে তাঁর তখনকার যে সংযোগ, তাতে তাঁকে ‘জাতীয়তাবাদী’ বলাও হবে দুষ্কর। কোন পথে এই পরিবর্তন ঘটল, তা এখনও চর্চার বিষয়। সমাজ-মনস্তত্ত্ববিদ আশিস নন্দী সাভারকরের এই পর্বের ব্যাখ্যায় জেলবাসের দিনগুলির গুরুত্ব উল্লেখ করেন। মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর সঙ্গে মানসিক দূরত্বও সাভারকরের এই পরিবর্তনের পিছনে অন্যতম সূত্র। তিনি মনে করেছিলেন, হিন্দু সভ্যতার অপ্রয়োজনীয় ও দুর্বল দিকগুলিই গান্ধীর প্রিয়, যেমন সনাতন গ্রামীণ ভারতের উপবাস-প্রথা, চরকা-চালনা, গরু নিয়ে আদিখ্যেতা ইত্যাদি। গান্ধীর আধুনিক বিজ্ঞানবিরোধিতা, ‘সত্য’সন্ধান, অহিংসা কিংবা পাশ্চাত্য রাষ্ট্রভাবনার বিরোধিতা সবই সাভারকরের কাছে ‘আনস্কলারলি’ ঠেকেছিল। তাঁর পছন্দ ছিল বরং পৌরুষসূচক হিন্দুত্ব, নিরামিষাশী পরিবারে জন্মেও তিনি মাংস খেতেন, কেননা মাংস না খেলে ‘পৌরুষসত্তার বিকাশ ব্যাহত হয়’। লন্ডনে নিজের বাড়িতে গান্ধীকে খাওয়ানোর সময়ে গান্ধী নিরামিষাশী শুনে তিনি বলেছিলেন, “এ সব না খেলে আমাদের সঙ্গে দেশের কাজ করবেন কী করে।”

Advertisement

অতঃপর সাভারকরের পৌরুষবাচক হিন্দু ভারত থেকে বাদ পড়ল মাতৃভূমি শব্দটাই। মাতা নয়, বরং পিতা হোক দেশ, এবং ভূমি-র মতো স্ত্রীলিঙ্গ শব্দও পরিত্যাজ্য, তাই নতুন শব্দ এল ‘পিতৃভূ’। তাঁর মানসলোকের সেই ‘ভূ’-তে অহিন্দুদের অধিকার নেই। হিন্দুত্ববাদের এই নতুন ধারাটিকেই আজকের ভারতে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টায় তাঁকে নিয়ে এত টানাটানি। নিরানব্বই বছর আগে, ১৯২৪ সালে জেল থেকে ব্রিটিশ কর্তাদের কাছে আবেদন করে, শর্তসাপেক্ষে তিনি যখন বেরিয়েছিলেন, তাঁর জেলসঙ্গীরা তখন ইন্দুভূষণ দত্তের মতো আত্মহত্যা করছেন কিংবা উল্লাসকর দত্তের মতো উন্মাদ হয়ে যাচ্ছেন। তবু সাভারকরের জীবনের সেই দ্বিতীয় পর্বটিই আজকের শাসকদের আরাধ্য, যখন তাঁর সংগ্রাম আর কখনওই ব্রিটিশবিরোধিতার দিকে ধাবিত হয়নি, হিন্দু ভারতের শত্রুদের প্রতিই তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ থেকেছে।

আরও পড়ুন
Advertisement