Society

ভালবাসার ধর্ম

যে পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে প্রবীণ শিক্ষক ভালবাসার কথা বলেছেন, সেখানে বড়রা দূরস্থান, ছোটদের ভালবাসা শেখানোও সহজ কথা নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২২ ০৬:২২
সুস্থ চিন্তা ও চেতনায় আস্থাশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে।

সুস্থ চিন্তা ও চেতনায় আস্থাশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে। প্রতীকী ছবি।

আয়ারল্যান্ড থেকে ১৯৬০ সালে কলকাতায় এসেছিলেন ব্রেন্ডান ম্যাকার্থি। তখন তাঁর বয়স বাইশ। সম্প্রতি স্বদেশে ফিরে গেলেন তিনি। কলকাতার একটি কলেজে দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করেছেন। ছাত্র এবং প্রিয়জনদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘ব্রাদার ম্যাক’ নামে। চুরাশি বছরের ম্যাক ভাইকে বিদায় জানাতে তাঁরা একটি সভার আয়োজন করেছিলেন। সেই সমাবেশে প্রবীণ শিক্ষক বলেছেন, “আমাদের জীবনের একটাই মানে। ভালবাসা। ভালবাসা যদি তোমার না থাকে, তা হলে তুমি ঠিক পথে নেই। তুমি যদি হিন্দু হও এবং মুসলমানদের ঘৃণা করো, তবে তুমি ভুল করছ। তুমি যদি মুসলমান হও এবং হিন্দুদের ঘৃণা করো, তবে তুমি ভুল করছ।... কমবয়সিরা যদি সবার আগে ভালবাসতে না শেখে, তা হলে বুঝতে হবে তোমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারছ না।” তাঁর আশির দশকের এক ছাত্র সস্নেহ শ্রদ্ধায় জানিয়েছেন— ম্যাক বরাবর ঠিক সময়ে ঠিক কথাটা মনে করিয়ে দিতেন।

‘বাস্তববাদী’ নাগরিকদের অনেকেই হয়তো গভীর সংশয় প্রকাশ করে বলবেন, “কথাগুলো ভাল, কিন্তু আজকের এই কঠিন কঠোর কর্কশ পৃথিবীতে অচল।” এই সংশয় অহেতুক নয়। যে পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে প্রবীণ শিক্ষক ভালবাসার কথা বলেছেন, সেখানে বড়রা দূরস্থান, ছোটদের ভালবাসা শেখানোও সহজ কথা নয়। ব্রাদার ম্যাক নিজেও শেষকালে বলেছেন, “সে খুব কঠিন কাজ।” বস্তুত, অলীক আশাবাদকে প্রশ্রয় দেননি এই শিক্ষাব্রতী, তাঁর ভালবাসার ধর্ম তাঁর মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করেনি। কিন্তু স্বধর্মে স্থিত থেকে তিনি নিঃসংশয় প্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করেন যে, নিজেদের ভাল চাইলে ওই কঠিন কাজটা করতে হবে, কঠিন বলেই সেটা আরও বেশি দরকারি। ওই সভায় কলেজের এক প্রাক্তনীর মন্তব্য: “আমরা স্কুলে কারও জাত, ধর্ম, এ-সব নিয়ে ভাবতেই শিখিনি। এখন সেই ভাবনাগুলো মুখে-চোখে ফুটে ওঠে, দেখলে শিউরে উঠতে হয়। আমরা আর নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারি না।” বাস্তবিকই, ভালবাসা এবং সহমর্মিতার বিপরীতে যে ঘৃণা এবং বিদ্বেষে আকীর্ণ ক্ষুদ্রস্বার্থের ধারণা সমাজের মানসিকতাকে উত্তরোত্তর গ্রাস করছে, তাকে প্রতিহত করা এখন সমাজের সুস্থ অস্তিত্বের শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement

এবং সেখানেই উপরোক্ত সংশয়কে অতিক্রম করে সুস্থ চিন্তা ও চেতনায় আস্থাশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন আছে সেই আস্থাকে সমাজে সঞ্চারিত করার। ছাত্রছাত্রীদের তরুণ মনে সুচিন্তার প্রসার ঘটানোর সর্বপ্রকার উদ্যোগ তার একটি বড় উপায়। বিদ্বেষ সেই মনের স্বাভাবিক ধর্ম নয়। গত শতাব্দীতে আমেরিকান কবি অগডেন ন্যাশ লিখেছিলেন: “এনি কিডি ইন স্কুল/ ক্যান লাভ লাইক আ ফুল,/ বাট হেটিং, মাই বয়, ইজ় অ্যান আর্ট।”— স্কুলে-পড়া যে কোনও শিশু একেবারে বোকার মতো ভালবাসতে পারে, কিন্তু ঘৃণা করা একটি শিল্প। তা রীতিমতো অনুশীলন করতে হয়। এই পঙ্‌ক্তিগুলি অধ্যাপক অমর্ত্য সেন স্মরণ করেছেন তাঁর ‘পরিচিতি ও হিংসা’ বিষয়ক অসামান্য আলোচনায়। প্রসঙ্গটির তাৎপর্য বিরাট। ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতপাত ইত্যাদি নানা দিক থেকে মানুষকে সঙ্কীর্ণ পরিচিতির খাঁচায় পুরে তাকে হিংস্র রাজনীতির শরিক করে তোলার যে বিরাট কর্মযজ্ঞ, তা আজ প্রতি দিন নতুন শক্তি সঞ্চয় করছে। এর ভয়াবহ পরিণাম দেশে ও দুনিয়ায় অতিমাত্রায় প্রকট। আজকের তরুণ প্রজন্মকে কি এই বিষাক্ত অন্ধকারের কবলে সমর্পণ করা হবে, না কি তাদের বোকার মতো ভালবাসতে পারার ক্ষমতাকে সম্মান করে, উৎসাহিত করে এই সমাজ সুচেতনার আলো জ্বালাতে চাইবে— ব্রেন্ডান ম্যাকার্থি দীর্ঘপ্রবাসের শেষে সহনাগরিকদের কাছে এই প্রশ্ন রেখে গিয়েছেন। মহাদেশ মহাসাগরের সীমা পেরিয়ে এই প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়বে— আশা রইল।

আরও পড়ুন
Advertisement