hijab

হিসাবি

নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা হইয়াছে, ‘ব্যক্তিগত আইন’-এর প্রশ্ন বলিয়া হাই কোর্ট তাহা বৃহত্তর বেঞ্চে পাঠাইয়াছে। আদালত সময় লইবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:০১

ফাইল চিত্র।

সংবিধান! তোমার দিন গিয়াছে। তাহা হইলে বঙ্কিমী বিলাপই আজিকার ভারতের জন্য একমাত্র প্রযুক্ত? কর্নাটকের হিজাব-বিতর্ক আবার বুঝাইল, ভারতীয় সংবিধান অধুনা কতখানি অপ্রাসঙ্গিক হইয়াছে। সেই রাজ্যের এক কলেজ মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরিধানে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় কয়েক জন পড়ুয়া তাহার প্রতিবাদ করিলে পাল্টা প্রতিবাদে অন্যরা গৈরিক অঙ্গবস্ত্র ঝুলাইলেন, হিন্দুত্ববাদীরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলিলেন। প্রতিবাদ ছড়াইল হিংসায়, বোম্মাই সরকার তিন দিনের জন্য রাজ্যের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করিয়া দিল— হিজাব-নিষেধাজ্ঞা জারি রাখিয়াই। নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা হইয়াছে, ‘ব্যক্তিগত আইন’-এর প্রশ্ন বলিয়া হাই কোর্ট তাহা বৃহত্তর বেঞ্চে পাঠাইয়াছে। আদালত সময় লইবে। রাজনীতির অবশ্য অত সময় লইলে চলে না। শিক্ষাঙ্গনে হিন্দু-মুসলমান, হিজাব-অঙ্গবস্ত্রকে লড়াইয়া দিয়া রাজনীতির লাভের অঙ্কটি কষিবার ব্যস্ততা অতি প্রবল, ভুলিলে চলিবে?

বিজেপির নেতারা শেষ কবে ভারতীয় সংবিধান খুলিয়া দেখিয়াছেন? খুলিলে দেখিতে পাইতেন, ২৫ হইতে ২৮ সংখ্যক অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে ধর্মাচরণের ‘মৌলিক’ অধিকারটি স্বীকৃত: ভারতের প্রত্যেক নাগরিক শান্তিপূর্ণ ভাবে নিজ নিজ ধর্ম আচরণ, অভ্যাস এমনকি প্রচারও করিতে পারেন, যদি না তাহা সমষ্টির শৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও স্বাস্থ্যের পরিপন্থী হয়। অনেক ধর্মেই পোশাক ধর্মাচরণের অংশ, মুসলিম নারীর হিজাব বা শিখ পুরুষের পাগড়িতে তফাত নাই। আবার গণতান্ত্রিক ভারতে পোশাক নির্বাচনের বিষয়টি নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারভুক্ত ও সংবিধান-স্বীকৃত; কে কী পরিবেন তাহা নিতান্তই তাঁহার ব্যক্তিগত ব্যাপার, প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা যেমন বলিয়াছেন— নারী বিকিনি পরিবেন কি ঘোমটা দিবেন, হিজাব পরিবেন কি জিনস, তাহা একান্তই তাঁহার অধিকার, ভারতের সংবিধানই সেই অধিকার নিশ্চিত করিয়াছে। কর্নাটকে বিজেপি সরকার যুক্তি দিয়াছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমতা নষ্ট হয় এমন পোশাক পরা যাইবে না, তাই হিজাবও বারণ। বিজেপি ভুলিয়াছে, বিদ্যায়তনে পোশাকসাম্য অর্থনৈতিক সাম্যের প্রতীকী, শ্রেণিকক্ষে ধনীগৃহ ও দরিদ্রকুটির হইতে আসা পড়ুয়াদের মধ্যে বিভেদরেখা মুছিবার প্রয়াসেই ছাত্রছাত্রীদের পোশাকবিধি একই রকম, সেই কারণেই তাহা ‘ইউনিফর্ম’। একুশ শতকেও কেন কেহ হিজাব পরিবে, যুগ বদলের সহিত ধর্মবিশেষের আচার-বিচার পাল্টানো উচিত কি না— এই সব আলোচনা নিশ্চয়ই হইবে, হওয়া দরকারও। কিন্তু সেই তর্কবিতর্কের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করিতে লাগে না! কর্নাটকে বিজেপির সমর্থক ও হিন্দুত্ববাদীরা যে পথ ধরিয়াছেন, তাহা আলোচনা নহে, হিংসার পথ। বিদ্বেষ ছড়াইবার পথ। দুইটিকে গুলাইয়া ফেলা চলিবে না। হিজাব ও নারীস্বাধীনতার প্রশ্নের উত্তর পোশাকের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করিয়া দেওয়া যাইবে না।

Advertisement

সাম্প্রতিক কালে সংবিধানের বিরুদ্ধতা করিবার এই সীমাহীন ঔদ্ধত্য বাড়িতেছে রাজ্য ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিপুল প্রশ্রয়েই— শাসক কিছু বলিবে না, তাহা জানিয়াই। এত দিনে স্পষ্ট যে, বর্তমান শাসক আসলে নারী বা পুরুষের স্বাধীনতা লইয়া ভাবে না, বরং তাহার একাংশের স্বাধীনতা হরণ করিবার কথাই ভাবে। ধর্মসম্প্রদায়বিশেষের খাদ্য বা পরিধান-অভ্যাসে বাধা দিতে চাহে। ইহাই তাহার রাজনীতির তুরুপের তাস। এবং এই তাসটি খেলিবার লক্ষ্যেই কর্নাটকে হিজাব-কাণ্ড যে উত্তরপ্রদেশে ভোটের প্রাক্‌-লগ্নে সুকৌশলে ধর্মীয় মেরুকরণ— তাহা লইয়াও সংশয় নাই। আগামী বৎসরের মধ্যভাগে কর্নাটকেও বিধানসভা নির্বাচন। তাহারও কিঞ্চিদধিক মহড়া হইয়া গেল এই বেলা। ক্ষমতার রাজনীতিকে শিক্ষাঙ্গনে পুষ্ট করা গেল। এই বিপুল লাভের হিসাবের মধ্যে সংবিধান ও গণতন্ত্রের ক্ষতি কতটুকুই বা!

আরও পড়ুন
Advertisement