Inflation

বিপজ্জনক অস্ত্র

অনুমান করা চলে যে, ভারতের বর্তমান মূল্যস্ফীতি অতিরিক্ত চাহিদা বা অতিবৃদ্ধিজনিত নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২২ ০৫:০১

মূল্যস্ফীতির হার লাগামছাড়া, ফলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক আরও এক দফা সুদের হার বাড়িয়েছে। আইন অনুসারে ব্যাঙ্ক দেশে ভোগ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হারকে দুই থেকে ছয় শতাংশের মধ্যে রাখতে বাধ্য— পর পর তিনটি ত্রৈমাসিকে হারটি তার বাইরে থাকলে ব্যাঙ্ক গণপরিসরে এই ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য। প্রশ্ন হল, সুদের হার বাড়িয়ে কি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? একাধিক অর্থনীতিবিদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দীর্ঘকালীন পরিসংখ্যান বিচার করে দেখেছেন যে, সুদের হার বাড়লেই মূল্যস্ফীতির হার কমবে, এমন কোনও সরলরৈখিক সম্পর্ক নেই। ভারতের ক্ষেত্রেও তেমন সম্পর্কের এমন কোনও পরিসংখ্যানগত তাৎপর্যপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবুও কেন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়ানোর পথেই হেঁটেছে, তার কারণটি সহজ— ব্যাঙ্কের হাতে ব্যবহারযোগ্য ওই একটি অস্ত্রই আছে। পরিসংখ্যান বলছে যে, ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকেই ভারতে মূল্যস্ফীতির হার লাগামছাড়া। ৩২ মাসের মধ্যে ১৮ মাসে মূল্যস্ফীতির হার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নির্ধারিত সহনসীমার ঊর্ধ্ব মাত্রা ছয় শতাংশের বেশি ছিল। কেন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হল, তা বিস্তারিত তর্কের বিষয়। কিন্তু, অর্থশাস্ত্রীদের মতে, যেখানে ব্যাঙ্কের প্রাথমিক ও প্রধানতম কর্তব্য হওয়া উচিত ছিল মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ, সেখানে ব্যাঙ্ককে অন্য বিবিধ দিকে মন দিতে হয়েছে। প্রাথমিক দায়িত্বটি তুলনায় কম গুরুত্ব পেয়েছে।

বিপত্তি কেন ঘটল, সেই আলোচনা জরুরি। কিন্তু, সেই বিপত্তি ঠেকাতে গিয়ে যে পদক্ষেপ করা হচ্ছে, তাতে নতুনতর বিপত্তি হতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখা আরও জরুরি। মূল্যস্ফীতি একাধিক কারণে হয়ে থাকে। জোগানের চেয়ে চাহিদার পরিমাণ বেড়েগেলে যেমন মূল্যবৃদ্ধি ঘটে, তেমনই উৎপাদনের কাঁচামাল বা অন্তর্বর্তী পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলেও মূল্যস্ফীতি হয়। আবার, অর্থব্যবস্থার কোনও কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলেও মূল্যবৃদ্ধি মাথাচাড়া দিতে পারে। প্রশ্ন হল, ভারতে এখন কোন ধরনের মূল্যস্ফীতি চলছে? গত কয়েক বছরে যে পরিসংখ্যান সরকার গোপন করেছে, আর যে পরিসংখ্যান গণপরিসরের আলো দেখতে পেয়েছে, দুই-ই নির্দেশ করছে যে, ভারতে চাহিদা নিম্নগামী। এবং, তা অতিমারির কারণে ঘটেনি— কোভিড-১৯ আরম্ভ হওয়ার আগে থেকেই চাহিদার গতিভঙ্গ হয়েছে। অতএব অনুমান করা চলে যে, ভারতের বর্তমান মূল্যস্ফীতি অতিরিক্ত চাহিদা বা অতিবৃদ্ধিজনিত নয়। অতএব, সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে টাকার জোগান কমালেই এই মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আসবে, এই প্রত্যাশার গোড়ায় গলদ রয়েছে।

Advertisement

বরং, সুদের হার বাড়লে লগ্নির পরিবেশের আরও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা। সেই বর্ধিত সুদের প্রভাব পড়বে উৎপন্ন অন্তর্বর্তী পণ্যের উপরেও, যা চক্রাকারে ফিরে আসবে বাজারের সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধির হারে। অর্থাৎ, ক্ষেত্রবিশেষে সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বিপরীত ফলদায়ী হতে পারে। অতএব, সেই নীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাবধান হওয়াই বিধেয়। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক সেনসিটিভিটি অ্যানালিসিস জানিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যস্তর ভারতের মূল্যবৃদ্ধির উপর তুলনায় কম প্রভাব ফেলে— সমস্যাটি দেশের বাজারেই। ফলে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটি শুধুমাত্র রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উপর ন্যস্ত করলে চলবে না। সরকারের পক্ষেও অনেক কিছুই করা সম্ভব— পেট্রোপণ্যের উপরে শুল্ক কমানো, ন্যায্য মূল্যের দোকানের মাধ্যমে জনসাধারণকে খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরকার নির্ধারিত দামে দেওয়া, সেচ এবং হিমঘরের সুযোগসুবিধা বাড়ানো, মজুতদারি ও একচেটিয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ— এমন বহু কাজ মূল্যস্ফীতির হারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। সুদের হার বৃদ্ধির সহজ ও বিপজ্জনক অস্ত্রটি ব্যবহারের আগে সাবধান।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আরও পড়ুন
Advertisement