Economy

খরচের টাকা

গত দু’বছরের মধ্যে আঠারো মাসই চিনে জিনিসপত্রের দাম কমেছে। শুনলে মনে হয়, ক্রেতাদের পক্ষে এ তো সুসংবাদ! আসলে, লাগাতার মূল্যহ্রাস বস্তুটি অর্থব্যবস্থার পক্ষে অকৃত্রিম অভিশাপ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৫ ০৬:২৭

চিনের সরকার মহানুভব, এমন দাবি কমিউনিস্ট পার্টির অন্ধ ভক্তরাও সচরাচর করেন না। সেই সরকারই হঠাৎ কল্পতরু হয়ে উঠেছে— কার্যত না-চাইতেই সাধারণ মানুষের দু’হাত ভরে দিচ্ছে আর্থিক সুবিধায়। মাইনেপত্র বাড়ছে, সন্তান প্রতিপালনের জন্য নতুন ভর্তুকির ব্যবস্থা হচ্ছে; তার উপরে হাতুড়ি থেকে হাতি, সব কিছু কেনার জন্য সরকারি ছাড়ের ব্যবস্থা হয়েছে, যার মোট বাজেট ৪১০০ কোটি ডলার। এমনিতেই কমিউনিস্ট রাজত্ব, তার উপরে দেং জিয়াওপিং-এর খেটে খাওয়ার নীতি সে দেশে দীর্ঘ দিন ধরে সরকারের নীতির পথপ্রদর্শক— শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যে সরকার যতই উপুড়হস্ত হোক না কেন, এই জাতীয় রাষ্ট্রীয় ব্যয় চিনে পরিচিত ঘটনা নয়। এমন ব্যতিক্রমী পথে হাঁটতে হচ্ছে কেন? তার কারণটি আপাতদৃষ্টিতে অবাক হওয়ার মতো— গত দু’বছরের মধ্যে আঠারো মাসই চিনে জিনিসপত্রের দাম কমেছে। শুনলে মনে হয়, ক্রেতাদের পক্ষে এ তো সুসংবাদ! আসলে, লাগাতার মূল্যহ্রাস বস্তুটি অর্থব্যবস্থার পক্ষে অকৃত্রিম অভিশাপ। বাজারে চাহিদা নেই বলেই জিনিসপত্রের দাম কমাতে বাধ্য হয় সংস্থাগুলি, এর ফলে তাদের লাভের পরিমাণ কমে, শ্রমিক নিয়োগ কমে, মজুরিও কমে— অর্থব্যবস্থা চালিত হয় মন্দার দিকে। চিনের অভ্যন্তরীণ ভোগব্যয়ের বাজারে এই ঘটনাটিই ঘটছে। এত দিন সে ধাক্কা সামলানো যাচ্ছিল বৈদেশিক বাণিজ্যের কল্যাণে। ট্রাম্পের শুল্ক-রণদামামায় সে ক্ষেত্রে বিপুল অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ফলে, ভোগব্যয়ের বাজারকে চাঙ্গা করার প্রয়োজন অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠেছে। তারই প্রত্যক্ষ ফল এই সরকারি বদান্যতা।

Advertisement

বিষয়টি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ভারতের উদাহরণ দিয়ে তা বোঝা যেতে পারে। ২০০৭-০৮’এর আর্থিক মন্দায় গোটা দুনিয়া যখন থরহরি কম্প, তখন ভারতের গায়ে আঁচ লেগেছিল তুলনায় কম। তার কারণ ছিল ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের শক্তি— দেশের বাজারে যে চাহিদা ছিল, তার ফলে ভোগব্যয়ের জোরে বৈদেশিক বাজারের ধাক্কা সামলানো গিয়েছিল বহুলাংশে। অন্য দিকে, কোভিড-লকডাউনের সময়ে বিশ্বের বৃহৎ অর্থব্যবস্থাগুলির মধ্যে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হারই ধাক্কা খেয়েছিল সবচেয়ে বেশি। তার কারণ অতিমারিতেও ছিল না, লকডাউনেও ছিল না— ছিল তার আগের কয়েক বছরে অভ্যন্তরীণ বাজারে ক্রমাগত চাহিদা হ্রাসের মধ্যে। কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতায় সে সময়ের পরিসংখ্যান আজও অমিল— কিন্তু, ফাঁস হওয়া রিপোর্টের তথ্যে, অথবা একাধিক অর্থশাস্ত্রী কার্যত গোয়েন্দাগিরিতে নেমে যে ছবি তুলে এনেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, সেই সময়কালে বিশেষত ভারতের গ্রামাঞ্চলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। মানুষের হাতে টাকার অভাব ঘটলে স্বভাবতই চাহিদায় টান পড়ে। সেই দুর্বলতা কোভিডের সময়ে ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে ধরাশায়ী করেছিল।

চিন আপাতত এই বিপদটিকেই এড়াতে চাইছে। তবে, বিপদ একা চিনের নয়— ভারত এখনও অভ্যন্তরীণ চাহিদাহীনতার সমস্যা থেকে বেরোতে পারেনি। কিছু দিন আগেই ভোগ্যপণ্যের বাজারে চাহিদার অভাবের কথা বলেছিলেন সে ক্ষেত্রের এক অতিবৃহৎ সংস্থার কর্ণধার। দিনকয়েক আগেই নীতি আয়োগের সদস্য অরবিন্দ ভিরমানি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারতে যাঁদের চাকরি আছে, তাঁদের বেতনও মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। আর, যাঁদের চাকরি নেই, অথবা যাঁরা পারিবারিক ক্ষেত্রে বিনা বেতনে নিয়োজিত হয়ে সরকারি খাতায় কর্মসংস্থানহীন নন অথচ আয়হীন— তাঁদের কথা নতুন করে বলার নয়। এই অবস্থায় সরকারের কর্তব্য ছিল দেশের সিংহভাগ জনসংখ্যার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা। তার বদলে এক লক্ষ কোটি টাকা আয়কর ছাড় দেওয়া হয়েছে আয়ের শীর্ষে থাকা তিন শতাংশ মানুষকে। কেন্দ্রীয় সরকার যতই বলুক যে, বাইরের ধাক্কা সামাল দেওয়ার জোর অভ্যন্তরীণ বাজারের রয়েছে, সরকারি উদ্যোগ ছাড়া সেটি হওয়ার নয়। তার জন্য কোন পথে হাঁটা প্রয়োজন, অবিলম্বে তা ভাবতে হবে।

Advertisement
আরও পড়ুন