কোনও অবৈধ ব্যবস্থা চালু থাকলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যে প্রশাসনের কর্তব্য, রাজ্যের শাসকরা বিলক্ষণ সে কথা জানেন। হাওড়া জেলা প্রশাসনের কঠোর সিদ্ধান্তে সেখানে রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ানো অবৈধ টোটোর দিনও ফুরোল। অতঃপর, সেই টোটোগুলিকে নথিভুক্ত করা হবে, এবং তাদের ‘বৈধ’ করে তোলা হবে। ব্যস, অবৈধ টোটোর সমস্যার একেবারে মৌলিক সমাধান। প্রশাসন জানিয়েছে, যে-হেতু এই পেশার সঙ্গে বহু মানুষের রুজিরোজগার জড়িত, তাই এই টোটো বন্ধ করা হবে না। এই একই সূত্র রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। যেমন, পুরসভার অনুমোদিত ‘প্ল্যান’-এর তোয়াক্কা না করে যথেচ্ছ বহুতল নির্মাণের পর সামান্য জরিমানা দিয়ে তাকে ‘বৈধ’ করে নেওয়া হয়। ফুটপাত দখল করে হকার বসিয়ে দেওয়ার পর মানবিকতার স্বার্থে তাকেও মেনে নেয় প্রশাসন। এমনকি, তটভূমি সংক্রান্ত আইনি নির্দেশিকাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে তৈরি হওয়া হোটেলও ভাঙা যায় না, কারণ এই রাজ্যে ‘বুলডোজ়ার রাজ’ চলবে না বলে জানিয়ে দেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীই। মানুষের কথা না ভেবে নেতাদের উপায় নেই, কারণ এই মানুষই ইভিএম-এর বোতাম টেপেন। ভোটসর্বস্ব রাজনীতিতে তাই অবৈধকে বৈধ করে তোলার প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। এবং, গোড়ায় যা ‘অবৈধ’, তাকে চালু করার প্রক্রিয়াটিও দস্তুরমতো রাজনৈতিক। শাসক দলের স্থানীয় নেতার দরবারে প্রণামী দিলে সেই অবৈধ কাজ শুরু করার অনুমতি মেলে, এবং পরে রাজ্য প্রশাসন মানবিকতার স্বার্থে তাকে মেনে নেয়। এই ব্যবস্থার কথা রাজ্যবাসীও বিলক্ষণ জানেন। ফলে, রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তেই নিয়মিত এমন কার্যকলাপ চলতেই থাকে।
টোটো বস্তুটি এক নাগরিক বিভীষিকা। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গে নিয়ম মানার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই— এ রাজ্যের ধর্মই হল ‘যেমন খুশি চলো’। টোটোগুলি এই কথাটিকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছে— তারা সত্যিই যেমন খুশি চলে। ফলে, পাড়ার গলি থেকে জাতীয় সড়ক, সর্বত্রই তাদের অবাধ বিচরণ। রাস্তায় ভুল দিকে চলা; ‘নো এন্ট্রি’-র পরোয়া না করা; যে ফাঁকে সুচ গলে না সেখান দিয়েই গলে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস বজায় রাখা; এবং, আশেপাশে দাঁড়িয়ে বা চলতে থাকা গাড়ির গায়ে নিজেদের স্বাক্ষর রেখে যাওয়া, এ সবই পশ্চিমবঙ্গের টোটোদের স্বভাবধর্ম। তাদের অনাচার দেখেও চুপ করে থাকাই দস্তুর, কারণ কে না জানে, তাদের মাথায় কার আশীর্বাদী হাত রয়েছে। অতএব, টোটোর দৌলতে নিত্য যানজট, নিত্য বিশৃঙ্খলা। বিশেষত হাওড়ার মতো শহরে সে সমস্যা ভয়ঙ্করতর, কারণ ঐতিহাসিক ভাবেই সেখানকার রাস্তা সরু। এই সমস্যার সমাধান সহজ— যে রাস্তায় মোটর যান চলাচল করে, সেখানে টোটো নিষিদ্ধ করা। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গ সে পথে হাঁটবে না। অবৈধ টোটোকে নথিভুক্ত করে, তাদের জন্যনির্দিষ্ট পথ বেঁধে দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার একটি ভান করা হবে। এবং, দিনকয়েকের মধ্যেই টোটোগুলি সেই আইনও ভাঙতে আরম্ভ করবে। নথিভুক্ত টোটোর পাশাপাশি লাইনে এসে দাঁড়াবে নতুনতর অবৈধ টোটো। অশান্তি চরমে ওঠার পর প্রশাসন নিশ্চয়ই আরও এক বার এই অন্যায়কে বৈধ করে তোলার চেষ্টা করবে। সেই চেষ্টার উপরে জমা হবে নতুন অবৈধ কার্যক্রমের পলিমাটি। এ এক অনন্ত চক্র। এর থেকে মুক্তি মিলবে, রাজ্যবাসী আর সে আশা করেন না।