Syria

পর্বান্তর

যেন গলনাঙ্কের কাছেই এসে দাঁড়িয়েছিল আসাদ-রাজত্ব, হঠাৎ করে তা গলেপুড়ে শেষ হল। বিভিন্ন দেশ আসাদের সমর্থনে সক্রিয় ছিল এত দিন, তারা হঠাৎই যেন অনুপস্থিত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৭

আট ডিসেম্বর সিরিয়ায় যা ঘটে গেল, তার সম্যক অর্থ, কার্যকারণ ও ফলাফল বুঝতে এখনও কিছু সময় লাগবে। তবে এটুকু স্পষ্ট যে, সে দেশে বিরোধী শক্তি জোট অতর্কিতে আক্রমণের তীব্রতা যে ভাবে বাড়িয়ে চব্বিশ বছরের বাশার আল-আসাদ’এর শাসন ঘুচিয়ে বা’থ পার্টির ৬০ বছরের শাসন সমাপ্ত করল— তা কেবল সিরিয়ার জন্যে নয়, পশ্চিম এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রেই একটি বড় পর্বান্তর। ধাঁধার শেষ নেই। তেরো বছর ধরে হিংসায় উন্মত্ত হয়ে থেকেছে সে দেশ, তার মধ্যে সিংহভাগ সময়েই প্রেসিডেন্ট আসাদের ক্ষমতা থেকেছে তুঙ্গে। অথচ চূড়ান্ত পর্বে দেখা গেল, সিরিয়ার সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী প্রায় হিংসার আশ্রয় না নিয়েই সোজাসুজি আত্মসমর্পণ করছে। যেন গলনাঙ্কের কাছেই এসে দাঁড়িয়েছিল আসাদ-রাজত্ব, হঠাৎ করে তা গলেপুড়ে শেষ হল। বিভিন্ন দেশ আসাদের সমর্থনে সক্রিয় ছিল এত দিন, তারা হঠাৎই যেন অনুপস্থিত। এ-দিকে রক্তাক্ততম সংঘর্ষে ও ভয়ঙ্কর বিমানহানায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ গত দশকে গৃহহারা হয়েছেন, সিরিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রাক্তন ঠিকানা। কেবল ইউরোপে নয়, পৃথিবী জুড়ে এখন ‘সিরীয় উদ্বাস্তু’রা একটি বিপন্ন গোষ্ঠী বলে গণ্য। বিরোধী শক্তির প্রবল জয়ের পর কি সেই গৃহহীন উদ্বাস্তুরা দেশে ফিরবেন?

Advertisement

এক সময়ে দামাস্কাস ছিল একটি আধুনিক, সম্ভ্রান্ত মহানগর বা ‘মেট্রোপলিস’, বহু ইতিহাস ও বহু সংস্কৃতির ধারক। বিশ্ব-কূটনীতিতেও একটি বিশিষ্ট স্থান ছিল পশ্চিম এশীয় দেশটির, দুই দিকে যুযুধান রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শান্তিরক্ষায় বিশেষ সহায়ক। হেনরি কিসিঞ্জার আমেরিকার বিদেশসচিব হিসেবে মনে করেছিলেন, ‘মিশরকে বাদ দিয়ে কোনও যুদ্ধ হয় না, আর সিরিয়াকে বাদ দিয়ে কোনও শান্তি প্রয়াস হয় না।’ ইতিহাস যে কত বড় পরিহাসের সামনে এসে নিজেকে দাঁড় করায়, আজকের সিরিয়া তার উজ্জ্বল প্রমাণ। প্রায় দুই যুগব্যাপী গৃহযুদ্ধ তথা বকলমে আন্তর্দেশীয় যুদ্ধে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত এই মানবজমিনে এত দিন বিশেষ কোনও দেশ সহায়তার হাত বাড়ায়নি। বরং রাশিয়া, আমেরিকা, ইরান সকলেই নিজ নিজ স্বার্থে লাগাতার অস্ত্র, অর্থ ও সেনা সরবরাহ করে গিয়েছে। এখন কি যুদ্ধশেষে সিরিয়াকে আবার নতুন করে দাঁড় করাতে অন্তত কিছু দেশ এগিয়ে আসবে? প্রশ্নটি রইল সামনে।

রইল কূটনৈতিক ক্ষমতাবিন্যাসের জটিলতর প্রশ্নটিও। গৃহযুদ্ধ নামেই, বকলমে যে সিরিয়ায় চলছিল আমেরিকা-রাশিয়া সংঘাত, এত দিনে তা দাবদাহের মতো স্পষ্ট। রাশিয়া বরাবরই আসাদের বিশেষ আশ্রয়দাতা, ২০১৫ সালে থেকে সিরিয়াকে রাশিয়াই কোনও রকমে ঠেকা দিয়ে রেখেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেই সহায়তা দানে ঘাটতি পড়ছিল। ঠিক যেমন, গত বৎসরাধিক ধরে ইজ়রায়েলের হাতে প্যালেস্টাইন ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল আক্রান্ত হওয়ার জন্য ইরান ও লেবানন থেকেও সিরিয়ার পিছনে সমর্থন কমে আসছিল। সুযোগ বুঝেই আসাদ-বিরোধী জোট ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ক্ষমতাদখলে। আসাদ-পতনের ‘দুঃসংবাদ’ আসামাত্র সিরীয় ভূমিতে বিপুল আক্রমণ শাণাতে শুরু করেছে ইজ়রায়েল, যৎপরোনাস্তি ধ্বংস ও বিনাশই এখন তার লক্ষ্য। যুক্তি পরিষ্কার: আসাদ-বিরোধী ইসলামি শক্তিজোট এক বার সিরিয়ার শাসনভার পেয়ে গেলে ইজ়রায়েলের দুয়ারে মহা বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। বোঝা সহজ, কেন ইজ়রায়েলের প্যালেস্টাইন আক্রমণের ফলে সিরিয়ার এত দিনের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটল, কেন আসাদ-রাজত্ব এই ভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। কট্টর ইসলামি শক্তি এখন কী ভাবে আসাদ-সরকারের নেতাকর্তাদের শাস্তি দেয়, কী ভাবে সে দেশে মৌলবাদী শাসন জারি করে, গাজ়ায় ইজ়রায়েলের চলমান উন্মাদ কার্যক্রমের প্রতিশোধ কী ভাবে নিতে চায়, এমনকি শিয়াপন্থী ইরানের সঙ্গেও কী ভাবে শত্রুতা ঝালায়, দেখার অপেক্ষায় সমগ্র বিশ্ব।

Advertisement
আরও পড়ুন