pakistan

পদে পদে সঙ্কট

একের পর এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল ও মেরুদণ্ডহীন করে দেওয়া— এ সবের ফল কী হতে পারে, পাকিস্তান দেখিয়ে দিচ্ছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২২ ০৯:২৩

এই মুহূর্তে পাকিস্তানে সদ্য-ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে সামনে রেখে সে দেশের রাজনৈতিক সমাজের একাংশ বিক্ষোভে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছেন। ঘটনা যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে সে দেশের সমস্ত সচেতন নাগরিকই নিশ্চয় উদ্বিগ্ন। প্রতিবেশী ও অন্যান্য দেশও উদ্বেগ বোধ করতে পারে— কেননা পাকিস্তানের রাজনীতির স্থিতিশীলতার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজনীতি এবং বিশ্ব কূটনীতির সম্পর্ক রীতিমতো ঘনিষ্ঠ ও প্রত্যক্ষ। ইমরান খানকে কেন ক্ষমতা থেকে সরতে হল, তা নিয়ে ধোঁয়াশার কারণ নেই, তাঁকে কোনও মতেই সদাচারী, সংবিধান-মান্যকারী প্রধানমন্ত্রী বলা যায় না। ক্রমাগত দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র, অসাংবিধানিক কার্যক্রম এবং রাজনৈতিক অপকৌশল তাঁর কেরিয়ারের অঙ্গাঙ্গি ইতিহাস। তাঁর বিরুদ্ধে ‘অনাস্থা’ প্রস্তাব আনা এবং তা পাশ হওয়া, এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাঁকে সরতে হওয়া— এই গোটা ঘটনায় তাই বিস্ময়ের কিছু নেই। বেনজ়ির ভুট্টোর পুত্র তথা পিপিপি-নেতা বিলাবল ভুট্টো জারদারি-সহ অন্যান্য বিরোধীরা ঠিকই বলছেন, সম্ভবত সেনার একাংশের মদতে তিনি সে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটাতে চাইছিলেন। তাঁর ক্ষমতাচ্যুতিতে যেমন অবাক হওয়া যায় না, সঙ্গে সঙ্গে এও ঠিক যে, তিনি সরে যাওয়ার পর কে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেই নিষ্পত্তিও হয়ে গিয়েছে দ্রুত। তবে সঙ্কটটি কিন্তু থেকেই যাবে। পাকিস্তানের গণতন্ত্র এখনও পদ্ধতিগত এবং ব্যবহারগত ভাবে কতটা নড়বড়ে, এবং চরিত্রগত ভাবে বিস্ফোরক— তা আবার নতুন করে প্রমাণিত হল। উদ্বেগের কারণটি এখানেই নিহিত।

যে হেতু প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইমরান খান অসাংবিধানিক অনাচারকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে গণতন্ত্রের নতুন ভোর হিসাবে বর্ণনা করার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অথচ আদালত-নির্দেশিত এই তথাকথিত ‘গণতন্ত্র-উন্মেষ’-এর মুহূর্তটিতেও কিন্তু না ভেবে উপায় নেই যে, পদ্ধতিগত ভাবে এই পথ কতখানি বিপজ্জনক। মনে রাখা ভাল, যে সামরিক শক্তির প্রসন্ন দৃষ্টিতে ইমরান খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, আজ সেই সামরিক ‘এস্টাবলিশমেন্ট’-এর বিরাগভাজন হওয়াতেই তাঁকে সরতে হল। ফলত, ভবিষ্যতে যে বিচারবিভাগ সতত এগিয়ে এসে অ-সাংবিধানিক ক্ষমতাকে রুখতে প্রবল উদ্যোগী হবে— ইসলামাবাদ এবং রাওয়ালপিন্ডি কিন্তু এতখানি আশাবাদের অবকাশ দিচ্ছে না। আরও মনে রাখা ভাল, এর আগে এই বিচারবিভাগই কিন্তু নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে, কিংবা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিচারকের ক্ষেত্রে ‘অপ্রিয়’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে— যার পিছনে অভ্রান্ত প্রচ্ছন্ন (সামরিক?) অঙ্গুলিহেলন ছিল। এক বসন্তে সঙ্কট কাটে না: যে গণতন্ত্র অস্তিত্বশীল নয়, আদালতের এক রায়ে তার ‘উন্মেষ’ বা ‘উদ্‌যাপন’ ঘটে না।

Advertisement

ইমরানের বহিষ্কার তাই যে পাকিস্তানকে রেখে যাচ্ছে, তা আগের মতোই অতিরিক্ত সেনা-প্রাধান্যে বিপন্ন, গণতন্ত্রের উপর সামরিক সাঁড়াশির যন্ত্রণায় কাতর— এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই বাস্তব পাকিস্তানের জন্মমুহূর্ত যাবৎ নিত্যসঙ্গী। আজও তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। সংসদ থাকলেও তার মধ্যে শাসক ও বিরোধীর মধ্যে কোনও সংলাপ না-থাকা, একের পর এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল ও মেরুদণ্ডহীন করে দেওয়া— এ সবের ফল কী হতে পারে, পাকিস্তান দেখিয়ে দিচ্ছে। সংবিধান বলছে, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিলে ষাট থেকে নব্বই দিনের মধ্যে আবার তা তৈরি করতে হয়, সে ক্ষেত্রে ও দেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন হয়তো এ বছরেই ঘটবে। কিন্তু গণতন্ত্রের এই গোড়ার বৈকল্য যদি না সারানো যায়, তা হলে সব নির্বাচনই অসার, জনতার রায় তত ক্ষণই কুমিরের ছানা যত ক্ষণ সামরিক নেতৃত্ব তাকে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করে বাহবা নিতে চান।

আরও পড়ুন
Advertisement