West Begal Day

উদ্‌যাপনের সন্ধানে

বিষয়টি ঐতিহাসিক ভাবে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সাধারণ বুদ্ধি ও জ্ঞান নিশ্চয়ই শিখিয়েছে যে সব ‘ঐতিহাসিক’ দিনই ‘উদ্‌যাপন’যোগ্য নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:০৬

ভাদ্রের হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসছে, বাংলা দিবস কোনটি এবং কেন, তা নিয়ে যুক্তিতর্ক। আদৌ এমন ‘দিবস’-এর প্রয়োজন কী, তর্ক সে নিয়েও। বঙ্গবাসী যদি এত কাল একটি বিশেষ ভাবে নির্ধারিত ‘দিবস’ পালন না করেই তেরো-র স্থলে তিপ্পান্ন পার্বণে সানন্দে জনজীবন অতিবাহন করতে পেরে থাকেন, তা হলে কৃত্রিম ভাবে এ কাজ করার কারণ বোধগম্য হয় না। কিন্তু বোধগম্যতার বাইরেও একটি দুনিয়া আছে, সেই দুনিয়ায় কৃত্রিম ভাবে ‘দরকার’ তৈরি করাটাই যাঁদের কাজ— সেই রাজনীতিকরা ইতিমধ্যে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। তাঁদের প্ররোচনায় জনতার মুগ্ধ আবেগও সোডার মতো ভসভসিয়ে উঠতে শুরু করেছে। সুতরাং বিষয়টিকে নিয়ে ভাবা জরুরি বটেই। প্রথমেই বলে নেওয়া জরুরি, এই প্রকল্পটি রাজনৈতিক— প্রথমত ও শেষত।

Advertisement

এই পরিপ্রেক্ষিতেই ২০ জুন ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালনের ঘোষণাটি বিচার্য। এর পিছনে যে ‘রাজনীতি’, সেটি নিছক ঘোষণাতেই আবদ্ধ নয়— বোঝা গিয়েছে এ বছর রাজভবনে স্বয়ং রাজ্যপালের উদ্যোগে ‘দিবস’টি পালন করার সমারোহের সূত্রে। পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হিসাবে বিজেপি এই দিনটিকে ‘উদ্‌যাপন’-এর জন্য বেছে নিয়েছে, কেননা ১৯৪৭ সালে এই দিনটিতেই বঙ্গ কংগ্রেস দেশভাগের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। বিষয়টি ঐতিহাসিক ভাবে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সাধারণ বুদ্ধি ও জ্ঞান নিশ্চয়ই শিখিয়েছে যে সব ‘ঐতিহাসিক’ দিনই ‘উদ্‌যাপন’যোগ্য নয়। ‘স্বাধীনতা’ উদ্‌যাপন করা হয়, ‘দেশভাগ’ উদ্‌যাপন করার প্রশ্ন ওঠে না। ২০ জুনকে বেছে নেওয়াও তাই অত্যন্ত আপত্তিকর। দেশভাগের সিদ্ধান্ত ছিল দুর্ভাগ্যময়, দুঃখজনক— যে-হেতু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বরাবর অখণ্ড, ঐক্যবদ্ধ ভারতের জন্যই অসামান্য আত্মত্যাগ করেছিলেন— বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও তাই। কোনও মৃত্যুকে যেমন স্মরণ করলেও উৎসবে পরিণত করা হয় না, তেমনই একটি স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যুকেও উৎসব পালনের কার্যক্রম করে তোলা কেবল অগ্রহণযোগ্য নয়— অন্যায়। অনৈতিক। এবং বিপজ্জনক। কেননা দেশভাগের এই অত্যন্ত কষ্টকর সিদ্ধান্তটি নিতে হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান বিভেদের রাজনীতি ও তৎপ্রসূত সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের বাতাবরণে। সেই অবিশ্বাস ও শত্রুতার ঘোর কালো আঁধার যে কারণেই বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সে সময় নেমে এসে থাকুক না কেন, (তা ইতিহাসের বিশ্লেষণের বিষয়), তাকে আজ ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ উদ্‌যাপন ও উৎসবের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাটি— এক কথায়, কদর্য রাজনীতি, চূড়ান্ত অমানবিক কার্যক্রম।

এই নেপথ্য-প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক ‘বাংলা দিবস’ সিদ্ধান্তটি দেখা ভাল। বর্তমান ভারতে বসে নতুন করে বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না যে, কিছু কিছু ‘অমানবিক’ ও ‘কদর্য’ রাজনীতির দৈত্যকে এক বার বোতল থেকে বার করলে তার সুবোধ আত্ম-প্রত্যাহারের আশা করাই বাতুলতা। সুতরাং এই দৈত্য থাকছে, থাকবে— ধরে নিয়েই বিরুদ্ধ রাজনীতিকে বিকল্প পন্থা ভাবতে হচ্ছে। হয়তো এটিই তৃণমূল সরকারের তরফে সাম্প্রতিক ‘বাংলা দিবস’ প্রস্তাবের হেতু। যাঁরা এই প্রস্তাবে বিজেপির কার্যক্রমের দর্পণ-প্রতিফলন দেখছেন, তাঁরা নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার রাজনীতির কার্যকারিতাকে বাড়িয়ে ভাবছেন। বাস্তবিক, এক কালে অসুস্থ, বিভেদকামী রাজনীতিকে উপেক্ষার যে ধারা ছিল, অনেক দিন আগেই তা গতাসু। ‘উপেক্ষা’র রাজনীতি যে মোটেই সফলকাম হয়নি, সুবুদ্ধির পরিচায়ক হয়নি, নরেন্দ্র মোদীর ভারত তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। সে দিক থেকে এই বিকল্প ‘বাংলা দিবস’ ঘোষণার একটি স্পষ্ট যুক্তি আছে। নববর্ষের দিনটি বেছে নেওয়ার মধ্যেও সুবিবেচনা আছে। এই দিনটি সত্যই বঙ্গীয় সংস্কৃতির নিজস্ব, বহু কাল ধরে তা বাঙালির বিভিন্ন ও বিবিধ শ্রেণি, গোষ্ঠী, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে পালন করে আসছে। বৈশাখী হালখাতা থেকে রাবীন্দ্রিক নববর্ষ, নানা মতে এর বন্দনা প্রচলিত থেকেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই পয়লা বৈশাখকে বড় করে উদ্‌যাপনের একান্ত সমর্থক ছিলেন। হয়তো তাঁর মানসপটেও এই দিনটির মধ্যে অন্যান্য সত্তা-অতিক্রমী বাঙালিত্বের এক অমিত সম্ভাবনা প্রতিফলিত হয়েছিল। শেষে অবশ্য একটি আক্ষেপ না করে গতি নেই। প্রতিবেশী বাংলাদেশ সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াই নববর্ষকে একটি জাতীয় উৎসব করে তুলতে পেরেছে, বাংলা ও বাঙালির গৌরব সম্মেলক ভাবে উদ্‌যাপিত করার ধারা বহু দশক ধরে পালন করে আসছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি তেমনটা পারেনি কেন— রাজনীতির সমালোচনা করার সময়ে বাঙালি সমাজ তা নিয়েও নাহয় একটু ভাবুক।

আরও পড়ুন
Advertisement