Civic Volunteer

দাপট

কাগজ-কলমে নিয়ম হল, জমা পড়া দরখাস্ত থেকে বাছাই করে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে পুলিশ কমিশনার বা সুপারের নেতৃত্বাধীন কমিটির বিবেচনামাফিক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৫৫
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

সিভিক ভলান্টিয়ার বস্তুটি যত দিন যাবৎ আছে, তাকে ঘিরে বিতর্কও কার্যত তত দিন ধরেই চলছে। আর জি কর-কাণ্ডে সিভিক ভলান্টিয়ারদের এক্তিয়ারবহির্ভূত আচরণ ও বিবিধ অন্যায় নিয়ে যে প্রশ্নগুলি উঠেছে, ভেবে দেখলে তার কোনওটিই চরিত্রগত ভাবে নতুন নয়। ব্যাধিটি ব্যক্তিবিশেষের নয়, ব্যাধি ব্যবস্থার। যে বিষয়টি নিয়ে জনমানসে বিপুল ক্ষোভ, তা হল সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগে অনিয়ম। কাগজ-কলমে নিয়ম হল, জমা পড়া দরখাস্ত থেকে বাছাই করে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে পুলিশ কমিশনার বা সুপারের নেতৃত্বাধীন কমিটির বিবেচনামাফিক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হবে। অভিযোগ যে, বাস্তবে এই নিয়োগের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিই নিয়ন্ত্রিত হয় শাসক দলের ক্ষমতাবান নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে। তাঁদের বেছে দেওয়া প্রার্থীরাই সিভিক ভলান্টিয়ার হিসাবে মাসে দশ হাজার টাকা বেতনে নিয়োগ করতে হয়। স্বভাবতই, এই নিযুক্তি রাজনৈতিক ‘ক্লায়েন্টেলিজ়ম’-এর অঙ্গ— নেতা চাকরির বিনিময়ে এই সিভিক ভলান্টিয়ারদের আনুগত্য কেনেন। অন্য দিকে, এই সিভিকরাও জানেন যে, তাঁদের মাথায় ‘দাদা’ অথবা ‘দিদি’র হাত আছে, ফলে পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শনের অধিকারটিকে পকেটে নিয়েই তাঁরা কাজে ঢোকেন। কর্মক্ষেত্রে তাঁদের দাপটের একটি অংশ রাজনৈতিক সংযোগের কারণে; অন্য অংশটি উর্দির জোরে। পুলিশ না হয়েও পুলিশের ক্ষমতার অধিকারী হওয়া এই সিভিকরা সচরাচর হাতে মাথা কাটেন, এমন অভিযোগ গত তেরো বছর ধরেই পশ্চিমবঙ্গের হাওয়ায় ভাসছে। ২০১৭ সালে সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগের মূল আদেশনামা পাল্টে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হলে কাজ থেকে বহিষ্কারের নিয়মটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। আগেই এই সিভিকদের ক্ষমতা ফলানোর অভ্যাস নিয়ন্ত্রণের উপায় ছিল না; আইন পাল্টানোয় সেটুকুও থাকল না।

Advertisement

তবে, রাজনৈতিক নিয়োগই একমাত্র সমস্যা নয়। সংবাদে প্রকাশ, সিভিক ভলান্টিয়ারদের অনিয়মের কথা উঠলেই বিভিন্ন মাপের পুলিশকর্তারা হাত তুলে দিয়ে বলছেন যে, এঁদের নিয়োগপত্র না-থাকায় সিভিকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা, বিভাগীয় তদন্ত করা মুশকিল। কথাটি মিথ্যা নয়। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে, এই আধা-আইনি ব্যবস্থার আলোছায়ার সুবিধা নিতে এক শ্রেণির পুলিশকর্তাও পিছিয়ে থাকেন না। সিভিক ভলান্টিয়াররা তাঁদের যে সব ব্যক্তিগত কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকেন বলে অভিযোগ, সেই কাজের জন্য তাঁদের রাজকোষের অর্থব্যয়ে নিয়োগ করা হয়নি। বাতাসে কান পাতলেই অভিযোগ শোনা যায় যে, থানা স্তরের আধিকারিকরাও নাকি সিভিক ভলান্টিয়ারদের আকছার তোলা আদায়ের কাজে ব্যবহার করে থাকেন। আইন ও বেআইনের মধ্যবর্তী ধূসর অঞ্চলের চরিত্রই হল, যাঁর হাতে যতটুকু ক্ষমতা তিনি সেটুকু ব্যবহার করেই সেই ধূসর অঞ্চল থেকে সুবিধা আদায় করতে চান। গোটা রাজ্যই যখন এই নিয়মে চলছে, তখন সিভিক ভলান্টিয়ারদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে কেন?

সমস্যার আরও একটি স্তর আছে— প্রশিক্ষণের অভাব। পশ্চিমবঙ্গে পুলিশকর্মীদের মধ্যেই প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার অভাব ভয়ঙ্কর; কোন কাজটি তাঁর এক্তিয়ারভুক্ত, আর কোনটি অনধিকারচর্চা, সেই ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান বেশির ভাগ পুলিশকর্মীরই হয় না, কারণ যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের সেই কথাগুলি শেখানো হয় না। সিভিক ভলান্টিয়ারদের ক্ষেত্রে সেটুকুরও বালাই নেই— এক সপ্তাহের ‘প্রশিক্ষণ’ নিয়ে তাঁরা আইনরক্ষার কাজে সহায়তা করতে নিযুক্ত হন। একে সার্বিক শিক্ষা ও সচেতনতায় ঘাটতি, তার উপরে রাজনৈতিক নেতার দাপটের প্রসাদভোগী, তায় আবার প্রশিক্ষণের অভাব— সব মিলিয়ে সিভিক ভলান্টিয়ারদের একটি বড় অংশ যে অবতারে পরিণত হন, যে কোনও সভ্য সমাজের পক্ষেই তা বিপজ্জনক। সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যেও রাজ্য সরকারের হুঁশ ফিরবে, তেমন আশা করতে ভরসা হয় না।

আরও পড়ুন
Advertisement