খাদ্যপণ্যের বেলাগাম দাম বাড়ার ফলে খুচরো পণ্য মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যস্ফীতির হার পৌঁছে গেল প্রায় এগারো শতাংশে। গত পনেরো মাসে এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির হার। ফলে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমাবে, সেই ক্ষীণ সম্ভাবনাটিও লোপ পেল। কেন খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি এমন ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছেছে, তার কয়েকটি কারণ নির্দেশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। প্রথম কারণ, অকালবর্ষণে ক্ষতি হয়েছে পেঁয়াজ ও টমেটোর মতো আনাজের। ফলে, সেগুলির দাম আকাশছোঁয়া। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই সমস্যাটি শুধুমাত্র এ বছরের নয়— বিগত কয়েক বছর ধরেই অনিয়মিত বর্ষা প্রভাব ফেলছে শস্য উৎপাদনের উপরে। জোগান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ফলে দামও চড়ছে। সমস্যাটি বিশ্ব-উষ্ণায়নজনিত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল। এই সমস্যা যে কাল না হোক পরশুর পরের দিন মিটে যাওয়ার নয়, এ কথাটি এত দিনে স্পষ্ট। কিন্তু, জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে কৃষিনীতি সংস্কারের কাজটি এখনও শম্বুকগতিতে চলেছে। পরিবর্তিত জলবায়ুর ঘাত প্রতিরোধী বীজ তৈরি করা থেকে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, কোনও কাজেই প্রয়োজনীয় অগ্রগতি হয়নি। কৃষি গবেষণায় সরকারি বিনিয়োগও বাড়েনি তেমন ভাবে। ফলে, কোনও বছর অতিবৃষ্টি, কোনও বছর অনাবৃষ্টি, আর কোনও বছর অকালবৃষ্টি— কৃষির উপর পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাব খাদ্যপণ্যের বাজারে প্রভাব ফেলবেই।
মূল্যবৃদ্ধির দ্বিতীয় পথটি হল আমদানির বাজার। ভারত মূলত ভোজ্য তেল, ফল, ড্রাই ফ্রুট বা শুকনো ফল ও ডাল আমদানি করে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে, তার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। কিন্তু, সরাসরি আমদানিকৃত পণ্যের দাম বৃদ্ধি ছাড়াও আরও একাধিক পথে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব দেশের বাজারে পড়তে পারে। প্রথমটি হল, পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধি, যার ফলে পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে। আন্তর্জাতিক পরিবহণের ক্ষেত্রেও যেমন কথাটি প্রযোজ্য, তেমনই দেশের বাজারে পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এখনও অবধি পেট্রোলিয়ামের দাম সহনীয় সীমায় রয়েছে, কিন্তু পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ভারতকে উদ্বেগে রাখবে। দ্বিতীয় আশঙ্কাটি প্রবলতর। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় সে দেশের বাণিজ্য নীতিতে যে পরিবর্তন ঘটাতে চলেছে, তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে ডলারের সাপেক্ষে টাকার বিনিময় মূল্যে। ইতিমধ্যেই টাকার দাম সর্বকালীন তলানিতে পৌঁছেছে। আশঙ্কা যে, আরও অনেকখানি পতন ঘটতে পারে টাকার। যে-হেতু ভারতের মোট আমদানির পরিমাণ মোট রফতানির পরিমাণের চেয়ে বেশি, টাকার দামে পতন ঘটলে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়বে। এবং, টাকার দাম কমলে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে খাদ্যপণ্যের বাজারেও।
প্রশ্ন হল, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কী করতে পারে? দীর্ঘ ও মাঝারি মেয়াদের পদক্ষেপ হিসাবে জলবায়ু পরিবর্তন-প্রতিরোধী চাষের পথে হাঁটা প্রধানতম কর্তব্য। কৃষি-পরিকাঠামো ও গবেষণার ক্ষেত্রে আরও অনেক বিনিয়োগ প্রয়োজন, যাতে দেশে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসাবে এক দিকে আমদানি, এবং অন্য দিকে কালোবাজারি বা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের প্রবণতায় লাগাম টানা ভিন্ন উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে সমস্যার চেহারাটি কী রকম, তা পশ্চিমবঙ্গের একটি উদাহরণ থেকে বোঝা যেতে পারে। এ রাজ্যে হিমঘরের দরজায় আলু বিক্রি হচ্ছে পাইকারি ২৫-২৬ টাকা প্রতি কিলোগ্রাম দরে। খুচরো বাজারে সেই আলুরই দাম হচ্ছে ৩৫-৪০ টাকা। এই মধ্যবর্তী স্তরে কিলোগ্রামে পাঁচ টাকার বেশি দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই বলেই বিশেষজ্ঞদের মত। তবুও ঘটনাটি ঘটছে, যার দায় বইতে হচ্ছে ক্রেতাকে। খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ও বাজারের কাঠামোগত সমস্যাগুলি সমাধান করার পাশাপাশি এই অনৈতিক প্রবণতাগুলি রোধ করার জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।