উৎসব শব্দের মূলে যে ‘সু’ ধাতুর উপস্থিতি আছে, তাহা ক্রমেই বিস্মৃতপ্রায়। স্বঘোষিত হিন্দুত্ববাদীদের চাপের সম্মুখে প্রত্যাহৃত হইল এক খ্যাতনামা বস্ত্র বিপণির বিজ্ঞাপন ‘জশন-এ-রিয়াজ়’— যে উর্দু শব্দবন্ধের অর্থ ‘ঐতিহ্যের উদ্যাপন’। হিন্দু উৎসব দীপাবলির ‘ইসলামিকরণ’-এর বিরুদ্ধে কোমর বাঁধিয়া নামিলেন বিজেপির ছোটবড় নেতাগণ, সংস্থাকে ‘অর্থনৈতিক ক্ষতি’র হুমকি দিলেন— সংস্থাটিও বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করিয়া লইল। অপর এক বিজ্ঞাপনে অভিনেতা আমির খান কর্তৃক শব্দবাজি না ফাটাইবার স্বাভাবিক অনুরোধটিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার রং চড়িল। ইতিপূর্বে গহনার বিজ্ঞাপনে আন্তঃধর্ম সম্প্রীতিপূর্ণ সংসার অথবা সাবানের বিজ্ঞাপনে হিন্দু ও মুসলমান শিশুর ক্রীড়ারত চিত্র দেখিয়া যাঁহারা চটিয়াছিলেন, এই বারেও সেই হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরাই চটিয়াছেন। আনন্দ-জমকের বহরে ধার্মিকতাকে সামাজিকতায় সম্প্রসারিত করিয়া লওয়াই উৎসবের প্রধান চরিত্র। সঙ্কীর্ণ পরিসরে বাঁধিতে চাহিবার ফলে উহার প্রাণধর্ম ক্ষুণ্ণ হইতেছে, আত্মা বিনষ্ট হইতেছে।
এই প্রচেষ্টা বিপজ্জনক। এক্ষণে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, হিন্দিভাষা বা হিন্দুধর্ম, কাহারও উর্দুর বিরুদ্ধে কবচের প্রয়োজন নাই। হিন্দির ন্যায় উর্দুও উত্তর ভারতের ক্রোড়েই বিকশিত, সংবিধানে উল্লিখিত বাইশটি ভাষার তালিকাতেও তাহার সগৌরব উপস্থিতি; স্বাধীনতা সংগ্রামী হইতে কবি, প্রেমিক হইতে ছড়াকার— নানা মননে তাহা পরিপুষ্ট। যাঁহারা বারংবার হিন্দিভাষা ও হিন্দুধর্মকে ‘রক্ষা’ করিবার জন্য খড়্গহস্ত হইতেছেন, তাঁহারা সম্ভবত এই বিপুল বৈচিত্রের চিরন্তন সত্যটি জানেন না, অথবা জানিয়াও অস্বীকার করিতে চাহেন। এই রাজনীতির অভীষ্ট মেরুকরণ ও বিভাজন, সম্প্রীতির বিজ্ঞাপন তাই তাঁহাদের বাণে বিদ্ধ, ঘৃণা এবং ধর্মান্ধতায় যাহার প্রকাশ। জনতা নেতানুসারী— সহাবস্থানের সংস্কৃতি এবং বৈচিত্রের সাধারণ সমৃদ্ধ জমিটি ত্যাগ করিয়া তাঁহারাও ক্রমশ নজরদার বাহিনীতে পরিণত হইতেছেন। নিজের বিচক্ষণতাকে রাজনীতির নিকট বন্ধক রাখিয়া সাধারণ মানুষ নেতাদের ক্ষুদ্রতাকেই বরণ করিয়া লইতেছেন। এবং, সঙ্কীর্ণমনা রাজনীতির বিষ সমাজে ছড়াইয়া পড়িতেছে।
বস্তুত, উদ্বিগ্ন হইবার পরিসরটি নিতান্ত সামান্য নহে। আজ যে গা-জোয়ারি বিজ্ঞাপনে দেখা গেল, গত কাল তাহারই সাক্ষী ছিল কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনাসভা; আগামী কাল যে নিতান্ত ব্যক্তিগত পরিসরের সামাজিক অনুষ্ঠানও তাহার আঁচ এড়াইতে পারিবে, তেমন নিশ্চয়তাও কি আর দেওয়া সম্ভব? টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে এই যূথবদ্ধ রাজনৈতিক আক্রমণকে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ভাবিয়া লইবার বিন্দুমাত্র কারণ নাই— নাগপুর গোটা দেশে যে হিন্দুত্ববাদী চিন্তা-আধিপত্য বিস্তার করিতে চাহে, এই আক্রমণগুলি তাহারই সুপরিকল্পিত অংশ। সেই গৈরিক চিন্তা-আধিপত্যের নিকট যাহা ‘অপর’, তাহাই আক্রমণের যোগ্য। এই অবস্থানটি কাঠামোগত ভাবেই ভারতের ধারণাটির বিপ্রতীপ— ভারত হইল বৈচিত্রের, প্রতিস্পর্ধী অবস্থানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিসর। সেই পরিসরটিকে বাঁচাইয়া রাখা জরুরি। নাগপুরের একশৈলিক ধারণার বাহিরেই যে ভারতের আত্মা বাঁচিয়া থাকে, তাহা ভুলিলে, এবং ভুলিতে দিলে, চলিবে না। সেই সংগ্রামই একমাত্র পারে ভারতকে রক্ষা করিতে।