কলকাতা পুরসভা সহসা নড়েচড়ে বসেছে। অবাক কাণ্ড বটে। তবে তার চেয়েও বড় বিস্ময় জাগে এই কারণে যে, জরাজীর্ণ অথবা ভেজাল মশলায় তৈরি বাড়ি ভেঙে পড়ার মতো কোনও সঙ্কটের মুখে পড়ে তার এই নড়াচড়া নয়, তার উদ্যোগের লক্ষ্য হল বাংলা ভাষার মর্যাদা ফেরানো। পুরসভা নির্দেশ জারি করেছে, আগামী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মধ্যে মহানগরের সমস্ত দোকানপাটের নাম সম্বলিত বোর্ডে, সব হোর্ডিংয়ে, জনপরিসরে প্রচারিত যাবতীয় ঘোষণাপত্রে বাংলা ভাষাকে স্থান দিতে হবে। অন্য ভাষার ব্যবহার অবারিত, কিন্তু বাংলাকে বাদ দেওয়া চলবে না। এই নির্দেশ কার্যকর করার জন্য ইতিমধ্যে কলকাতা পুলিশের কাছেও নাকি আনুষ্ঠানিক বার্তা পৌঁছে গিয়েছে। কিছু কাল আগে বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার, পুরসভার এই নড়াচড়া দৃশ্যত তার সূত্র ধরেই। দুষ্টু লোকে অবশ্য প্রশ্ন তুলতে পারে, কেবল ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতিকে মর্যাদা দিতে এমন অ-স্বাভাবিক তৎপরতা কি এই রাজ্যে সম্ভব, না কি এই তোড়জোড়ের পিছনে ভিন্নতর অনুপ্রেরণাও কাজ করছে? কিন্তু এই কূটপ্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই। কারণ যা-ই হোক, বঙ্গসমাজ নিশ্চয়ই পুরসভার এই উদ্যোগকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করবে।
এবং একই সঙ্গে এই সংশয়ও জানাবে যে— পুরসভার ঘোষণা কেবল কথার কথা হয়েই থেকে যাবে না তো? সংশয়ের বিলক্ষণ কারণ আছে। দোকানপাটের নাম-ফলকে বা বিজ্ঞাপনী প্রচারলিপিতে বাংলা ব্যবহার আবশ্যিক করার উদ্যোগ এই শহরে নতুন নয়। ২০০৭ সালে কলকাতা পুরসভা কার্যত একই ধরনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। সিদ্ধান্ত বলবৎ করার অভিপ্রায়ে পুরকর্তারা কিছু দিন তৎপরও হয়েছিলেন। কিন্তু ফল? ২০০৯ সালে দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে: কলকাতার প্রায় ৫ লক্ষ দোকানের সাইনবোর্ডের মধ্যে মোটামুটি ৩০ শতাংশে বাংলা হরফ দেখা যাচ্ছে, তার দুই-তৃতীয়াংশে আগে থেকেই বাংলা উপস্থিত ছিল। অর্থাৎ দু’বছরে পুরসভার নির্দেশিকাটির সাফল্যের হার ছিল ১২ শতাংশের সামান্য বেশি। এক কথায় বললে: হয়নি, হয়নি, ফেল। এই ব্যর্থতা দ্বিগুণ পীড়াদায়ক, কারণ প্রায় দু’দশক আগেকার সেই উদ্যোগের পিছনে নাগরিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। জনপরিসরে বাংলা হরফ ব্যবহারের দাবিতে প্রবল উৎসাহে সরব ও সক্রিয় হয়েছিলেন সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি জগতের বেশ কিছু মানুষ। তা সত্ত্বেও জনপরিসরে বাংলা ভাষার অনাদর কার্যত একই রকম থেকে গিয়েছিল। স্পষ্টতই তার কারণ, বৃহত্তর সমাজ ওই উদ্যোগের প্রতি উদাসীন থেকে গিয়েছিল।
গত দু’দশকে সেই ঔদাসীন্য ও অনাদর আরও বহুগুণ বেড়েছে। দোকানপাটের নাম বা বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং থেকে শুরু করে সর্বত্র বাংলা ভাষা এখন আরও অনেক বেশি অ-দৃশ্য, অথবা তাকে আতশকাচ দিয়ে দেখতে হয়। কিন্তু যেখানে বাংলা হরফ দেখা যায় সেখানেও প্রায়শই ভাষার অপরিসীম অশুদ্ধতা ও দৈন্য দেখে মনে হয়, ভাষার শিক্ষা ফের বর্ণপরিচয় থেকেই শুরু করা দরকার। বলা বাহুল্য, এই দুর্দশার পিছনে আছে গভীরতর সামাজিক বাস্তব, বিশেষত শিক্ষার দৈন্য। সামগ্রিক ভাবেই, স্কুলের পঠনপাঠনের মান ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর। বাংলা শিক্ষাও তার থেকে মুক্ত হতে পারে না, পারেনি। কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্য একাধিক কারণ। এক দিকে, শিক্ষার ধারণাটি উত্তরোত্তর ‘কেরিয়ার’ তৈরির উপকরণে পরিণত হয়েছে এবং ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের কাছে সেই উপকরণ হিসাবে বাংলা ভাষার দরদাম ক্রমশই কমছে। অন্য দিকে, বাংলা পড়ার স্বাভাবিক অভ্যাসটিও সমাজের এক বড় এবং ক্রমবর্ধমান পরিসরে ক্রমশই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠছে। দুর্ভাগ্যের কথা, নাগরিক সমাজের উচ্চতর মহলেও এই বিষয়ে সচেতনতার কোনও লক্ষণ নেই। এই অবস্থায় পুরসভা এবং রাজ্য সরকারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রবল ভাবে সক্রিয় হতে হবে। কেবল সাইনবোর্ডে বাংলা লেখার ব্যবস্থা নয়, সমস্ত সরকারি নথিতে ও প্রচারে যত দূর সম্ভব বাংলার ব্যবহার চালু করা জরুরি। দায়সারা, যথেচ্ছ ভুলভ্রান্তি ও হাস্যকর অপপ্রয়োগে কণ্টকিত বাংলা নয়— যথাযথ, নির্ভুল ও সুষ্ঠু বাংলা। সেই কাজের জন্য সত্যকারের যুদ্ধকালীন উদ্যোগ চাই, শিক্ষার সংস্কার যে উদ্যোগের অপরিহার্য অঙ্গ। পুরসভার নতুন নির্দেশিকাটি যদি সেই পরিবর্তনের নান্দীমুখ হয়ে উঠতে পারে, বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীর মঙ্গল। ধ্রুপদী তকমার চেয়ে তা অনেক দামি।