Chief Justice of India

নামভূমিকায়

তাঁর রায়ে সংবিধানের ব্যাখ্যা ভারতীয় গণতন্ত্রের যাত্রাপথে মাইলফলক হয়ে থাকবে। আদালতের কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়।

Advertisement
সুহাসিনী ইসলাম
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৪৫
প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়।

প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়। —ফাইল চিত্র।

নভেম্বরের ১১ তারিখ অবসরগ্রহণের পর নিজের বর্ণময় কর্মজীবনের দিকে যখন ফিরে তাকাবেন প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়, কোন ঘটনাটিকে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করবেন তিনি? অযোধ্যার রাম জন্মভূমি মামলায় ঐতিহাসিক রায়ের শরিক হওয়া? শবরীমালা মন্দিরের দরজা প্রজননক্ষম বয়সকালের মহিলাদের জন্য খুলে দেওয়া? নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা? না কি, ঔপনিবেশিক বিচারব্যবস্থার উত্তরাধিকার বয়ে চলা তরবারি হাতে চোখে কাপড় বাঁধা ন্যায়ের মূর্তিকে পাল্টে এক ভারতীয় নারীর রূপ দেওয়া, যাঁর এক হাতে তুলাদণ্ড অন্য হাতে সংবিধান, এবং চোখ খোলা?

Advertisement

কোনও একটি মুহূর্তকে সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ বলে বেছে নেওয়া সম্ভবত বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের পক্ষেও সহজ হবে না। ভারতীয় গণতন্ত্র যখন ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন এলাহাবাদ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসাবে মনোনীত হয়েছিলেন তিনি, ২০১৬ সালে। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে দেশের প্রধান বিচারপতি পদে আসীন হলেন তিনি, সুপ্রিম কোর্টের পঞ্চাশতম প্রধান বিচারপতি। সেই সঙ্গে একটি বৃত্তও সম্পূর্ণ হল। তাঁর পিতা, যশবন্ত বিষ্ণু চন্দ্রচূড় ছিলেন দেশের ষোড়শ প্রধান বিচারপতি— সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময় প্রধান বিচারপতি পদে আসীন ছিলেন তিনিই, ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৮৫-র জুলাই অবধি। মোরারজি দেশাইয়ের আমলে প্রধান বিচারপতি হিসাবে মনোনীত হওয়া বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর সংঘাত সুবিদিত। তাঁরই পুত্র ধনঞ্জয় চন্দ্রচূড় দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে অর্থশাস্ত্রে স্নাতক হওয়ার পর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়েই আইনবিদ্যার পাঠ নেন। তার পর আমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে আইনবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ডি ডিগ্রি অর্জন।

দেশে ফিরে বম্বে হাই কোর্টে আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি। পেশাদারি জীবনের প্রথম পর্ব থেকেই বিবিধ সামাজিক প্রশ্নে তাঁর অবস্থান ছিল প্রগতিশীল। এইচআইভি-এডস’এ আক্রান্ত হওয়ায় কাজ হারিয়েছিলেন এক শ্রমিক। তাঁর হয়ে মামলা লড়েন চন্দ্রচূড়। বম্বে হাই কোর্ট রায় দেয় যে, কেউ কাজ করতে শারীরিক ভাবে সক্ষম হলে, তিনি শুধু এডস-আক্রান্ত বলেই তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যায় না। মহিলা ও সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার্থেও একাধিক মামলায় আইনজীবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন চন্দ্রচূড়। তিনি নিজেই জানান, বম্বে হাই কোর্টে বিচারপতি থাকার সময় প্রবীণ বিচারপতি রঞ্জনা দেশাইয়ের থেকে তিনি ‘নারীবাদী দৃষ্টিকোণ’ অর্জন করেছিলেন।

১৯৯৮ সালে, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে বম্বে হাই কোর্টে ‘সিনিয়র অ্যাডভোকেট’-এর স্বীকৃতি পান চন্দ্রচূড়। ব্যতিক্রমী ঘটনা, কারণ বয়স অন্তত চল্লিশ বছর না-পেরোলে প্রায় কেউই এই তকমা পান না। এর দু’বছরের মাথায়, ২০০০ সালে, বম্বে হাই কোর্টেই বিচারপতি হিসাবে নিযুক্ত হন তিনি। দীর্ঘ ১৩ বছর বম্বে হাই কোর্টে কর্মজীবনের পর ২০১৩ সালে এলাহাবাদ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। তার তিন বছরের মাথায় ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে প্রবেশ। ২০২২ সালে হন প্রধান বিচারপতি।

সুপ্রিম কোর্টে প্রথমে বিচারপতি এবং পরবর্তী কালে প্রধান বিচারপতি হিসাবে মোট ১২১১টি বেঞ্চের সদস্য থেকেছেন চন্দ্রচূড়, রায় লিখেছেন ৫৯৭টি। শীর্ষ আদালতে বর্তমানে যত বিচারপতি কর্মরত, তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক রায় লিখেছেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়ই। তাঁর বিচারাধীন মামলাগুলির মধ্যে অনেকগুলিই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রভূত মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। তাঁর বিচারাধীন মামলাগুলি থেকে উঠে এসেছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন। ২০১৭ সালে বিচারপতি পুত্তুস্বামী বনাম ভারত যুক্তরাষ্ট্র মামলায় প্রতিষ্ঠিত হয় যে, ব্যক্তিগত পরিসরে নিরাপত্তার অধিকার সংবিধানস্বীকৃত জীবনের অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। হাদিয়া মামলায় ধ্বনিত হয় প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী ধর্ম বা বৈবাহিক সঙ্গী বেছে নেওয়ার ব্যক্তিগত অধিকারের কথা। ২০১৮ সালে একটি রায়ে জানান যে, দিল্লির নির্বাচিত রাজ্য সরকার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের ইচ্ছাধীন নয়, বরং তাঁকেই মানতে হবে সরকারের পরামর্শ। সে বছরই নবতেজ জোহর বনাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র মামলার রায় সমকামিতাকে অপরাধের গ্লানি থেকে মুক্ত করে। অযোধ্যা মামলায় পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ রায় দেয় যে, বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দিরই প্রতিষ্ঠিত হবে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের এজলাসে ওঠা মামলা ও তার রায় ভারতীয় গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বিবিধ মাইলফলক হয়ে থাকবে।

প্রযুক্তিতে আস্থাশীল প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টকে বহুলাংশে ‘কাগজমুক্ত’ করতে পেরেছেন। আইনজীবীদেরও উৎসাহ দিয়েছেন ডিজিটাল নথি ব্যবহারে। তবে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বা আধুনিক জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী হলেও যে নিজের শিকড়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা যায়, প্রধান বিচারপতির দিনলিপি সে সাক্ষ্য দেবে। সম্প্রতি ভাইরাল হল তাঁর বাসভবনে গণেশ পুজোর ছবি, যেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দিনকয়েক আগেই প্রধান বিচারপতি জানালেন, অযোধ্যা মামলার নিষ্পত্তি কামনা করে তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন। নিজের ধর্মবিশ্বাস প্রকাশ করলেও যে সব ধর্মের প্রতি সমদর্শিতার ধর্মনিরপেক্ষ নীতি বজায় রাখতে সমস্যা হয় না, প্রধান বিচারপতি জীবনচর্যায় সে কথাটি প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

আরও পড়ুন
Advertisement