‘দানের প্রতিযোগিতা’ (১৫-১১) সম্পাদকীয়তে সঠিক ভাবেই বলা হয়েছে যে, নির্বাচনী মরসুমে সব দলের অস্ত্র হয়ে উঠেছে দানখয়রাতি। এ রাজ্যের মানুষ ভোটের মুখে খয়রাতির ফুলঝুরি দেখতে বেশ কিছু কাল ধরেই অভ্যস্ত। কিন্তু মহারাষ্ট্র বিধানসভার ভোট এ রাজ্যকেও অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, সরকার এবং বিরোধী নির্বিশেষে ভোট রাজনীতিকে আজ এ রাস্তায় যেতে হচ্ছে কেন? কেন সরকারি দলগুলি তাদের কাজকর্মের দ্বারা মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারছে না? বিরোধী দলগুলিই বা সরকারের জনবিরোধী পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে নিজেদের জনমুখী নীতি ঘোষণার দ্বারা মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারছে না কেন? প্রধানতম সমস্যা— নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, শিক্ষা-চিকিৎসার খরচবৃদ্ধি প্রভৃতি ভোটে প্রধান আলোচ্য হয়ে উঠছে না কেন? উত্তর দেওয়ার দায় সংশ্লিষ্ট দলগুলিরই।
ভোটসর্বস্ব দলগুলির নাম এবং পতাকার রঙের কিছু পার্থক্য থাকলেও নীতিগত ক্ষেত্রে ফারাক কতটুকু, তা অবশ্যই বিচার্য। মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকারি দলগুলির যেমন কোনও ভূমিকা নেই, তেমনই বিরোধী দলগুলিও সরকারকে এ কাজে বাধ্য করার মতো কোনও নীতিগত অবস্থানে নেই। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ তাঁদের দীর্ঘ তিক্ত অভিজ্ঞতায় ধরেই নিয়েছেন, এই দলগুলির কোনওটিই তাঁদের স্বার্থে কিছু করবে না। তাই নগদে বা খয়রাতি হিসাবে যার থেকে যতটুকু বেশি পাওয়া যায়, মানুষ সেটুকুকেই প্রাপ্তি বলে মনে করছেন। ফলে যে দল বেশি অনুদান দেবে, ভোটও তারা পাবে বেশি। সে দল যদি চরম নীতিহীন, দুর্নীতিগ্রস্তও হয়, তবুও তাদেরই মানুষ সমর্থন করবেন।
যাঁরা খয়রাতির রাজনীতি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কাজেই লাগছে বলে মত প্রকাশ করছেন, তাঁদের বক্তব্য নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা-চিকিৎসার লাগামছাড়া খরচবৃদ্ধির তুলনায় এই খয়রাতি কতটুকু! বেশির ভাগ মানুষের স্থায়ী রোজগার না থাকায় সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা হয় না, পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হয় না। অর্থাৎ, খয়রাতির রাজনীতি মানুষের দুর্দশাকে স্থায়ী রেখে দলগুলির অনুগ্রহ-প্রার্থী হিসাবে তাঁদের ধরে রাখতে চায়। এর মধ্যে দিয়ে আত্মমর্যাদার জায়গাটাকেই শুধু নষ্ট করা হচ্ছে না, মানুষের ন্যায্য দাবি তোলার মন এবং লড়াইয়ের মানসিকতাকেও নষ্ট করা হচ্ছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খয়রাতির বিপুল অর্থ সরকার জোগায় ঋণ করে। সেই ঋণ শোধের টাকা জনগণের উপর কর চাপিয়ে তোলার চেষ্টা করে। তা ছাড়া খয়রাতির পিছনে সরকারের ব্যয় যত বাড়ে, মানুষের যথার্থ উন্নয়নের পিছনে খরচ তত কমে। যেমন, সরকার একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের হাতে ট্যাব তুলে দিচ্ছে, কিন্তু স্কুলগুলির পরিকাঠামোগত ঘাটতি মেটাচ্ছে না। প্রশাসনের অন্য ক্ষেত্রগুলিও নিয়োগের অভাবে ধুঁকছে, পরিষেবা দুর্বল হয়ে পড়ছে। সুতরাং, খয়রাতির রাজনীতিতে মানুষের মঙ্গল কতটুকু, সন্দেহ থেকেই যায়।
ইন্দ্র মিত্র, কলকাতা-৩১
অপমানের ভাতা
‘দানের প্রতিযোগিতা’ সময়োচিত, যুক্তিনিষ্ঠ। ভারতীয় রাজনীতিতে এই ট্রেন্ডটি এখন রমরমিয়ে চলছে। কে কত বেশি খয়রাতির কথা ঘোষণা করতে পারে, তারই প্রতিযোগিতা চলে। ভোট এলে এই প্রবণতা নতুন প্রাণ পায়। কোনও দল মহিলাদের ২১০০ টাকা মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে প্রতিপক্ষ দল ৩০০০ টাকা নিয়ে হাজির হয়। কেউ ১০০০ টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করলে বিরোধীরা ২৫০০ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। প্রশ্ন হল, এই যে সরকারি কোষাগার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা দানখয়রাত করে রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় বা ক্ষমতায় আসতে চায়, সেটা কি চরম সুবিধাবাদী নীতি নয়? এটা কি সংবিধান স্বীকৃত? জনগণের দেওয়া করের টাকা সরকার কি যেমন ভাবে খুশি খরচ করতে পারে? জনগণের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন নেই? যখন অনেক জনকল্যাণমূলক প্রকল্প স্রেফ টাকার জন্য আটকে আছে, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, পরিবহণ পরিকাঠামো অর্থের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, সেখানে এই দানখয়রাত কতটা যৌক্তিক, ভেবে দেখা দরকার। আর এই দানখয়রাতের ছায়ায় চাপা পড়ে যায় শাসকের একাধিক দুর্নীতি। যেমন পশ্চিমবঙ্গ। দানখয়রাতের খেয়ায় চেপে বছরের পর বছর শাসক দল নির্বাচনী বৈতরণি পেরিয়ে যায়। এটাকে কোনও মতেই প্রগতিশীল রাজনীতি বলা যায় না। এটা পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। রাজ্যে স্থায়ী ভাবে উন্নয়ন না করে, মানুষকে স্বনির্ভর না করে, সন্তোষজনক রোজগারের নিশ্চয়তা না দিয়ে শুধু ভিক্ষার দান বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার মধ্যে শাসকের বাহাদুরি থাকতে পারে, কিন্তু রাজ্যবাসীর পক্ষে তা চরম অপমানের।
পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। জনমনোরঞ্জনের জন্য একাধিক প্রকল্প চালু করেছে সরকার। সবটাই ভোটমুখী। যার প্রয়োজন আছে সেও প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছে, যার নেই সেও নিচ্ছে। শাসক দল দরাজহস্তে সবাইকে প্রকল্প পাইয়ে দিচ্ছে। চোখের সামনে দেখেছি স্বামীর ভাল রোজগার থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্য আবেদন করতে। প্রশ্ন, সরকার কার টাকা দিচ্ছে? জনগণের দেওয়া করের, যা রাজ্যের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করার কথা। এই দানখয়রাতের কিন্তু প্রকৃত গরিব মানুষ উপকৃত হচ্ছেন না। তাঁরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকছেন।
ভোটের জন্য দানের প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ভোট এলে নেতারা সাইকেল, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার, বিদ্যুতের বিল মকুবের কথা বলেন। কেউ বলেন না আমরা ক্ষমতায় এলে পরিবহণ, চিকিৎসা, শিক্ষা-পরিকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি সাধন করব? কেউ তো বলেন না যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব। ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতিতে দানের প্রতিযোগিতা ও দানখয়রাত বন্ধ করতে নতুন আইন আনা জরুরি।
অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি
অমানবিক
প্রাকৃতিক বিপর্যয় হোক কিংবা সামাজিক বা ব্যক্তিগত পরিসরে ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনা, সেগুলো মোবাইলবন্দি করে ‘ডিজিটাল’ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা কিছু মানুষের মধ্যে উত্তরোত্তর ভয়ানক আকার নিচ্ছে। ‘কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়’ (৩১-১০) শীর্ষক প্রবন্ধে প্রবন্ধকার ঠিক প্রশ্নই রেখেছেন, এই প্রবণতার বশবর্তী হয়ে দিনে দিনে আমরা আরও অসংবেদনশীল, অমানবিক হয়ে যাচ্ছি না তো?
২০২০ সালের আমপানের রাতে পাশের বাড়ির গোটা পাঁচেক বিশালাকৃতি গাছ পড়ে আমার বাড়ির দোতলার শৌখিন বারান্দা ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরের দিন ভোরবেলা থেকে দেখলাম দলে দলে মানুষ এসে সেই দৃশ্য দেখছেন এবং মোবাইলবন্দি করছেন। যত ক্ষণ না গাছগুলো কেটে সরানো হল, তত ক্ষণ পর্যন্ত আমাদের অসহায়তার সেই দৃশ্য-দর্শনে ভাটা পড়েনি। এই দর্শকরা এক বারের জন্যও আমাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাননি।
যদিও ‘ভার্চুয়াল’ জগতে বিচরণ করা এমন দৃশ্যাবলির অধিকাংশই বেশি দিন স্থায়ী হয় না। ফের নতুন ঘটনা ঘটে, তার ছবি-ভিডিয়ো পুরনোকে সরিয়ে জায়গা করে নেয়। বহু সচেতন মানুষও আছেন, যাঁরা এ সবের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তবুও স্বীকার করতেই হয়, অমানবিক উল্লাসের তাড়নায় এক দল মানুষ মোবাইলের ‘ক্যামেরা অন’ করে ছুটে চলেছেন, প্রতি মুহূর্তে নিজেদের উপস্থিতিহীন অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে, নিজেদের সর্বজনগ্রাহ্য করে তুলতে। এবং ‘কনটেন্ট’ হিসাবে তাঁরা বেছে নিচ্ছেন প্রকৃতি কিংবা মানুষের বিপর্যস্ত হওয়ার মুহূর্তগুলো। এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য আমাদের আর কী হতে পারে।
অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা